আবদুল্লাহ আল মনসুর ও একজন ইউসুফ ইসলাম
রমযান মাসে জীবনে সময়ের অভাব দেখা দেয় – যে কোন ভালো মুসলিমের তো বটেই – আমার মত সাধারণ মুসলিমেরও। আমি তাই ভেবেছিলাম, রমযান মাসে আর কোন পোস্ট দেব না – নিতান্ত যদি দিইও, তবে তা হবে pure ধর্ম্-কর্ম নিয়ে। কিন্তু “সামু”র জনপ্রিয় ব্লগার আবদুল্লাহ আল মনসুর-এর “মহান আল্লাহ্ পাকের অশেষ রহমতে বিরাট দুর্ঘটনা হতে বেঁচে আসলাম” – এই শিরোনামের একটা পোস্ট পড়ে মনে হলো, এই লাইনে কিছু লেখা যেতে পারে। এখনই না লিখলে চিন্তাটা হয়তো সময়ের সাথে হারিয়েও যেতে পারে – তাই এখনই লিখতে বসলাম।
আমি জানি তার সমকালীন অনেক ব্লগীয় বন্ধু – যাদের সাথে তিনি হর-হামেশা ভাব বিনিময় করে থাকেন, তারা নাস্তিক বা এগনোস্টিক। কিন্তু আবদুল্লাহ আল মনসুর বিশ্বাসী – আর সেই বিশ্বাস প্রকাশ করতে তিনি কখনো কূন্ঠা বোধ করেন না! আমার অনেক কয়টা সেকেলে পোস্টে এসে তিনি ইতিবাচক মন্তব্য বা রেটিং দিয়ে গেছেন – আমি তখনই নিশ্চিত হয়েছি যে, তিনি আল্লাহয় বিশ্বাস করেন এবং তা নিয়ে লজ্জিতও নন। ব্লগে স্মার্ট্ বা সুশীল হতে হলে ধর্মানুভুতি না থাকা অথবা ধর্মানুভূতিকে কটাক্ষ করাটা যে একটা শর্ত – তিনি বোধহয় সেটা মনে করেন না। তবু “মহান আল্লাহ্ পাকের অশেষ রহমতে বিরাট দুর্ঘটনা হতে বেঁচে আসলাম” শিরোনামের ভিতর যে গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ ফুটে উঠেছে, তা হয়তো অনেককেই থমকে দেবে – অনেকটা ধরুন, যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে, সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীতে গান শুনতে গিয়ে দেখেন যে, স.ম. তুকীউল্লাহ্ তার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু করার আগে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আস সালামু আলাইকুম” বলে শুরু করেন – তাহলে আপনার যেমন লাগবে! আমি বলছি না যে, স.ম. তুকীউল্লাহ্ বিশ্বাসী নন বা তিনি কখনো কাউকে সালাম দেন না – তবু, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনের সাথে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আস সালামু আলাইকুম” – ব্যাপারটা কেমন যেন “যায় না”!
যাহোক, যে কথা বলছিলাম “মহান আল্লাহ্ পাকের অশেষ রহমতে বিরাট দুর্ঘটনা হতে বেঁচে আসলাম” শিরোনামের ভিতর যে গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ ফুটে উঠেছে, তা হয়তো অনেককেই থমকে দেবে; কারণ, কাফির-মুশরিক-নাস্তিকদের দৌরাত্মে, “সামু”র অবস্থা আজ এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, এমন একটা বাক্য যেন কেবল রাজাকাররাই উচ্চারণ করতে পারে – অথচ, আবদুল্লাহ আল মনসুর তার ব্যানারে তো স্পষ্ট লিখেই রেখেছেন ৭১ আমার প্রেরণা….২১ আমার অহংকার। সেজন্য হয়তো ব্যাপারটা কারো করো কাছে আরো বেশী পীড়াদায়ক হবে। অথচ, একজন ন্যূনতম মুসলিমের জন্য এটাই তো স্বাভাবিক যে, কোন একটা fatal বিপদ থেকে বেঁচে গেলে, তার মনে প্রথমেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়ের কথা আসবে। আমরা অনেকেই হয়তো জেনে থাকবো যে, “কাফির” কথাটার প্রথম পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে “অবিশ্বাসী” – আর দ্বিতীয় পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে “অকৃতজ্ঞ” বা ingrate – যে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ – আল্লাহ তাকে যেসব favor করেছেন, সেগুলো যে স্বীকার করে না, বা, সেগুলোর জন্য শুকরিয়া আদায় করে না।
স্কলাররা বলেন: “কৃতজ্ঞতাবোধ” হচ্ছে আল্লাহকে ভালোবাসার প্রথম ধাপ এবং তাঁকে ভালোবাসার যুক্তিযুক্ত কারণ! তার গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ দেখে আমি যোশের বশবর্তী হয়ে বেশ বড় একটা মন্তব্যও লিখে ফেললাম:
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করুন এবং পারলে কিছু সাদাক্বা করুন।
জীবনের যে ভালো কাজগুলো আমরা “পরে করবো” বা “পরে দেখা যাবে” বলে তুলে রাখি, সেগুলো এখনই অবিলম্বে করার চেষ্টা করা যে উচিত – এই ধরনের ঘটনা আমাদের সেই কথা মনে করিয়ে দেয়। আপনি আরেকটা নতুন জীবন পেয়েছেন ধরে নিয়ে এই জীবনটার গোটাটা না হলেও, এর সিংহভাগই আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে পারেন – তবেই সত্যিকার শুকরিয়া আদায় করা হবে, ইনশা’আল্লাহ! ভুল বুঝবেন না – “আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়” বলতে আমি আপনাকে বিছানাপত্র মাথায় নিয়ে রাস্তায় নামতে বলছি না – তবে আল্লাহর বাণী মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়ার কাজ করতে পারেন – বিশেষত আপনি যেহেতু লেখালেখি করেন!
তখনই আমার আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়লো আর ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়েও লেখা যায়:
৭০-এর দশকের জনপ্রিয় বৃটিশ পপ তারকা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন – নাম নিয়েছেন ইউসুফ ইসলাম (গল্পটা তাঁর মুখে একটা লেকচারে শোনা)। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে একটা বীচে গিয়েছেন সাঁতার কাটতে। হঠাৎ মনে হলো সমুদ্রের undercurrent তাঁকে সমুদ্রের গভীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে…….আশে পাশে তাঁকে বাঁচানোর মত কেউ নেই – আর তাঁর শরীরের যে অবস্থা, তাতে তিনি নিজের চেষ্টায় কিছুতেই তীরে যেতে পারবেন না! তখন তিনি আল্লাহর কাছে নিজেকে “মানত” করে বললেন যে, আল্লাহ্ যদি তাঁর জীবনটা ফিরিয়ে দেন, তবে তিনি তা আল্লাহর পথে ব্যয় করবেন। এর পর আল্লাহর ইচ্ছায়, তীরে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ বা অন্যান্য ফ্যাক্টরের মিলিত ফলে, ইউসুফ এক সময় পায়ের নীচে মাটি পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে প্রথম যে কথাটা উদিত হলো, তা ছিল এরকম যে, “ইশ! গোটা জীবনটাই আল্লাহর পথে মানত করার কি দরকার ছিল, টাকা পয়সা বা অন্য কিছু করলেও তো হতো!” ইউসুফ নিজের মনের গোপন কোণে উদিত “অকৃতজ্ঞতার” কথা পৃথিবীকে না জানালেও পারতেন। কিন্তু “দায়ী ইলাল্লাহ্” বা “আল্লাহর পথে আহ্বায়ক” হিসেবে তিনি আমাদের শোনাচ্ছিলেন – বিপদ কেটে গেলে আমরা কি সহজেই, মুহূর্তেই ভুলে যাই যে, বিপদের মুহূর্তে আমাদের সর্বস্ব দিয়ে হলেও আমরা কি ভাবে জীবনটা ভিক্ষা চেয়েছিলাম! এটাই হয়তো সাধারণ মানুষের জন্য স্বাভাবিক যেমন আল্লাহ্ কুর’আনে বলেছেন:
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآَخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (64) فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ (65) لِيَكْفُرُوا بِمَا آَتَيْنَاهُمْ وَلِيَتَمَتَّعُوا فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ (66)
“আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানতো ৷ তারা যখন নৌযানে আরোহন করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে ৷ অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শিরকে লিপ্ত হয় ৷ যাতে আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা তারা অস্বীকার করতে পারে এবং তারা যেন ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকতে পারে ৷ অতঃপর শীঘ্রই তারা জানতে পারবে ৷” (কুর’আন, ২৯:৬৪-৬৬)
ইউসুফ তাঁর কথা রেখেছিলেন। গোটা জীবনটাই আল্লাহর পথে ব্যয় করে চলেছেন -আলহামদুলিল্লাহ্!
আমি বলছি না যে, আবদুল্লাহ আল মনসুর অকৃতজ্ঞ হবেন – তবু তাকে একটা সৎ উপদেশ দিতে গিয়ে আমি বলেছি: জীবনের যে ভালো কাজগুলো আমরা “পরে করবো” বা “পরে দেখা যাবে” বলে তুলে রাখি, সেগুলো এখনই অবিলম্বে করার চেষ্টা করা যে উচিত – এই ধরনের ঘটনা আমাদের সেই কথা মনে করিয়ে দেয়। কারণ, আমরা যে আরক দিন, আরেক মাস বা আরেক বছর বেঁচে থাকবো তা কে নিশ্চিত করবে? আর তাছাড়া, বিপদ কেটে গেলে, ঐ মুহূর্তের কৃতজ্ঞতাবোধের তীব্রতাটা ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে এবং আমরা আমাদের দৈনন্দিন “মৃত্যু ভুলে থাকা” জীবনে আবার মশগুল হয়ে যেতে পারি এবং যা করণীয় তা ভুলে বসতে পারি।
আবদুল্লাহ আল মনসুর-এর জন্য আজ আমি একটা বিশেষ দোয়া করছি – তার লেখনি যেন কৃতজ্ঞতাবশত আল্লাহর কথা লেখে – একথা জেনে যে, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষি নন, বরং আমরা সতত আমাদের অস্তিত্বের জন্যই তাঁর করুণাপ্রার্থী।