প্রশ্নঃ সুন্নাত সলাত না পড়লে কি গুনাহ হবে? সুন্নাত দুই প্রকার অামরা জানি। বিস্তারিত জানালে খুশি হবো।
প্রশ্নঃ সুন্নাত সলাত না পড়লে কি গুনাহ হবে? সুন্নাত দুই প্রকার অামরা জানি। বিস্তারিত জানালে খুশি হবো।
উত্তর দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
উত্তরঃ ধন্যবাদ আপনাকে। প্রথমত, সুন্নাত সম্পর্কে আগে আমাদের জানতে হবে ইনশাআল্লাহ৷ আমরা যদি সুন্নাতের পরিচয় জানি তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে সুন্নতের হুকুম কি? সুন্নাতের পরিচয় যেভাবে উসূলের কিতাবগুলোতে দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে,
السنة هي مايثاب فاعلها ولا يعاقب تاركها
সুন্নাত হচ্ছে সম্পাদনকারী অর্থাৎ যে সুন্নাত কাজটি করবে সে সওয়াব পাবে আর যে সেটিকে বর্জন করবে এর জন্য তাকে কোনো শাস্তি দেয়া হবে না। এটাই হচ্ছে সুন্নাতের পরিচয়। অধিকাংশ উসূলবিদগণ সুন্নাতের এই পরিচয় দিয়েছেন৷ তাই, আমরা যদি সুন্নাতের এই পরিচয়টুকু জানি তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে সুন্নাতের হুকুম হচ্ছে ইসলামী শরিয়তের মধ্যে এমন কাজ যে কাজের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, কোনোভানে বাধ্য করা হয়নি। এটি মান্দুব এবং মুস্তাহাবের পর্যায়ের। কিন্তু আল্লাহর নবী ﷺ করেছেন অর্থাৎ নবী ﷺ এর তা’আসসী বা অনুসরণের জন্য সুন্নাহর মর্যাদা অপরিসীম। কেননা এতে আপনি নবী ﷺ সরাসরি অনুসরণ করতে পারবেন। আপনি ঠিকই বলেছেন, অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য অনুযায়ী সুন্নাহ্ দুই প্রকার। যেমনঃ
১. আস সুন্নাহ্ আল মু’আক্কাদা অর্থাৎ সুন্নাতে মু’আক্কাদা বা তাগিদপ্রাপ্ত সুন্নাত।
২. আস সুন্নাহ্ গাইরিল মু’আক্কাদা অথবা আস সুন্নাহ্ আয যাইদা অর্থাৎ অতিরিক্ত সুন্নাত।
ঠিক এই ধরনের একটি পরিভাষা আমরা ফিকহুল হানাফীতেও দেখতে পাই, অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের ‘উলামায়ে কিরামও সুন্নাতকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তারা বলেছেনঃ
১. সুনানুল হুদা (সুন্নাতুল মু’আক্কাদা)
২. সুনানুল যাওয়ায়েদ
সুনানুল হুদা সম্পর্কে তারা বলেছেন “এটি এমন সুন্নাত যে সুন্নাতেটি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ নিয়মিত করেছেন বা স্থায়ীভাবে করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কখনো এটিকে বর্জন বা পরিহার করেননি।” এটাকে ‘উলামায়ে কিরাম সুন্নাতে মু’আক্কাদাও বলেছেন।
জমহুর ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য হচ্ছে যদি কোনো কারণে কোনো বান্দা সুন্নাত পড়তে না পারেন অথবা সুন্নাতকে ত্যাগ করেন তাহলে তিনি গুনাহ্গার হবেন না। এটি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.), ইমাম শা’ফী (রহ.), ইমাম মালেক (রহ.) এর মাযহাবের বক্তব্য।
কিন্তু হানাফী মাযহাবের ‘উলামায়ে কিরাম এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের একটি বক্তব্য হচ্ছে বা তারা অনেকে মনে করে থাকেন যে, সুন্নাতে মু’আক্কাদা এবং ওয়াজিব প্রায় কাছাকাছি। এজন্য বাদা’উস সানায়ের ১ম খন্ডের ১৫৫ পৃষ্ঠায় ইমাম কাসানী (রহ.) উল্লেখ করেন, তিনি বলেন,
لان السنة المؤكدة والواجب سواء خصوصا ما كان من شعائر الاسلام
“সুন্নাতে মু’আক্কাদা এবং ওয়াজিব মূলত সমান। বিশেষ করে যেগুলো ইসলামের নিদর্শনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এমন পর্যায়ের সুন্নাত মূলত ওয়াজিবের সমান পর্যায়ের।” এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে যে তিনি সুন্নাতকে এভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন যে, এমন কিছু সুন্নাত আছে যেগুলো ইসলামের মৌলিক নিদর্শনগুলো বা ইসলামের শা’আয়েরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এসমস্ত সুন্নাহগুলো ওয়াজিবের কাছাকাছি এবং এগুলো ওয়াজিবের হুকুম বহন করে থাকে তাদের কাছে। এটাকে যদি কেউ পরিহার করেন বা ছেড়ে দেন তাহলে তিনি গুনাহগার হবেন। কিন্তু তিনি কি আসলেই গুনাহ্গার হবেন? না কোন পর্যায়ের গুনাহ্গার হবেন সেটা আমরা ফিকহুল হানাফীতে থেকে দেখবো পারি। তখন আমাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ফিকহুল হানাফীতে ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন সুন্নাতুল হুদার ব্যাপারে আদ দুররুল মুখতারের মধ্যে, রুদ্দুল মুখতারের, আত তাহরির ওয়াত তাহবিরের মধ্যে ইবনুল হুমাম (রহ.) এভাবে উল্লেখ করেছেন যে,
سنة الهدى يوجب تركها إساءة وكراهة وسنة الزوائد لايوجب ذلك
“সুন্নাতে মু’আক্কাদাকে তরফ করা বা বর্জন করা মূলত তিরষ্কার এবং অপছন্দনীয়তাকে বাধ্যতামূলক করে।” এখানে বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি তিরষ্কারের মুখোমুখি হবেন এবং অপছন্দনীয় কাজ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন কিন্তু তিনি গুনাহ্গার হবেন ন। আর অতিরিক্ত সুন্নাত বা সুন্নাতুল যাওয়ায়েদ আছে সেগুলো যদি কেউ পরিহার করে থাকেন তাহলে তিনি এ অবস্থার মুখোমুখি হবেন না অর্থাৎ তার কোনো ধরনের গুনাহ্ হবে না।
এ কথাটি মুলত মানারের মধ্যে এবং মানারের শরহের মধ্যে মোল্লা জীবন (রহ.) তিনিও স্পষ্ট করে বলেছেন যে, “যদি কেউ সুন্নাতে হুদা বা সুন্নাতে মু’আক্কাদাগুলো আদায় না করে থাকেন তাহলে তিনি শুধু তিরষ্কারের মুখোমুখি হবেন, গুনাহের মুখোমুখি হবেন না।” যদিও ফিকহুল হানাফীর মধ্যে একদল ‘উলামায়ে কিরাম গুনাহের কথা উল্লেখ করেছেন। যারা গুনাহের কথা উল্লেখ করেছেন তারা মূলত সুনানুল হুদাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন অর্থাৎ সুন্নাতে মু’আক্কাদাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তাদের একদলের বক্তব্য হচ্ছে যেসমস্ত সুন্নাতে মু’আক্কাদাগুলো শা’আইরুল ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত সেগুলো যদি কোনো ব্যক্তি তরক করেন তাহলে তিনি গুনাহ্গার হবেন৷ আর যেসমস্ত সুন্নাতে মু’আক্কাদাগুলো শা’আইরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয় সেগুলো যদি কেউ তরক করে থাকেন তাহলে তিনি গুনাহ্গার হবেন না কিন্তু তিনি তিরষ্কারের মুখোমুখি হবেন এবং তার এই কাজটি নিন্দিত হবে৷ আমরা এখানে একটি উদাহরণ আনতে পারি সেটি হচ্ছে, আযান এবং জাম’আতে অংশগ্রহণের বিষয়টি জমহুর ‘উলামায়ে কিরামের মতে ওয়াজিব৷ সুতরাং আযান এবং জাম’আতে অংশগ্রহণ করা সলাতের জন্য ওয়াজিব। কিন্তু এটিকে ফিকহুল হানাফীতে সুন্নাতে মু’আক্কাদা বলা হয়েছে। সুন্নাতে মু’আক্কাদা বলার কারণে তারা বলেছেন যে কেউ যদি জাম’আত তরক করেন তাহলে তিনি গুনাহ্গার হবেন এবং ইসা’আ বা তিরষ্কারের মুখোমুখি হবেন। আর আযান পরিহার করলেও তিরষ্কারের মুখোমুখি হবেন। মূলত, এই মাস’আলার মধ্যে তারা যেই উদাহরণটি দিয়েছেন এই উদাহরণের মধ্যেই ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে এবং উদাহরণটি সঠিক হয়নি। কারণ, আযান এবং জাম’আতের বিষয়টি ইসলামী শরিয়তের মধ্যে এত মৌলিক বিষয় যে আল্লাহর নবী ﷺ কখনো তরক করেন নি। বরং আল্লাহর নবী ﷺ এটি নির্দেশ দিয়েছেন, নির্দেশের পাশাপাশি নবী ﷺ এ ব্যাপারে হুমকি দিয়েছেন এবং সতর্কতাবাণী উচ্চারণ করেছেন। সুতরাং এটিকে ওয়াজিব বলার ক্ষেত্রে ফিকহুল হানাফীতে কোনো ধরনের বাধা নেই। তাই সুন্নাতে মু’আক্কাদা বলে যদি আমরা এ মাস’আলাকে চালিয়ে দেই তাহলে এ কাজটি শুদ্ধ হবে না৷ মূলত এ কাজটি ওয়াজিব। ওয়াজিব না হলেও ওয়াজিবের কাছাকাছি এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এক্ষেত্রে জমহুর ‘উলামায়ে কিরাম এটিকে তরক করলে গুনাহ্গার হবেন এটি স্পষ্টভাবে বলেছেন৷ কিন্তু, ফিকহুল হানাফীতে এটিকে তারা কোনো কোনো জায়গার মধ্যে সুন্নাতে মু’আক্কাদা বলেছেন। যদিও ইমাম আবু হানিফার (রহ.) এক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি এক রেওয়াতের মধ্যে এটিকে ওয়াজিবও বলেছেন। যদি এটি হানাফী মাযহাবে সুন্নাতে মু’আক্কাদা হয়ে থাকে তাহলে তাদের অভিমত অনুযায়ী শা’আইরুল ইসলাম হওয়ার কারণে এটি ওয়াজিবের কাছাকাছি হবে এবং এটি তরককারী ব্যক্তি অবশ্যই গুনাহ্গার হবেন। বাদা’উস সানায়ের মধ্যে ইমাম কাসানী (রহ.) এভাবে উল্লেখ করেছেন কারণ তাদের কাছে সুন্নাতে মু’আক্কাদারও স্টেজ বা পর্যায় রয়েছে যেটি আমরা আগে বলেছি। যেগুলো ইসলামের নিদর্শনের সাথে সম্পৃক্ত আর এগুলো যদি কেউ তরক করে থাকেন তাহলে তিনি গুনাহ্গার হবেন। এগুলো কেউ তরক করলে গুনাহ্গার হবেন এ বিষয়ে হানাফী মাযহাবের সাথে অন্য ‘আলেমদের দ্বিমত পাওয়া যায় না কারণ এগুলো জমহুর ‘উলামায়ে কেরাম ওয়াজিব বলেছেন, সুন্নাত বলেন নি। আর দ্বিতীয় প্রকারের সুন্নাত হচ্ছে ঐসমস্ত সুন্নাত যেগুলো রাসূলুল্লাহ্ ﷺ অধিকাংশ সময় আদায় করেছেন। যেমন, রাওয়াতেব, সলাতুদ দুহা এবং ফজরের সুন্নাত সলাত। এ সুন্নাতগুলো যদি কোনো কারণে কোনো বান্দা বর্জন করে থাকেন তাহলে তিনি গুনাহ্গার হবেন না এটিই বিশুদ্ধ বক্তব্য। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সবাইকে বিষয়গুলো উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন।