সমুদ্রে জীবন – ৬
হঠাৎ মনে হলো এর আগের একটা পোস্টে, (আমি যখন ঐ জাহজে ছিলাম, তখনকার) আমার কেবিনের একটা জানালার (বা port hole-এর) ছবি দিয়েছিলাম! কেউ সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেন নি যে:এমন সাধারণ একটা জিনিসের ছবি কেন দিলাম? আর আমিও ভুলে গিয়েছি! এই ছবিটা তোলার একটা বিশেষ কারণ ছিল। সাধারণত জাহাজের জানালাগুলোর উচ্চতা এর অর্ধেক, বা তারও কম হয়। কিন্তু দঃ কোরিয়ায় বানানো ঐ জাহাজটিতে (এবং এর আগে, এর চেয়ে কিছু ছোট দঃকোরিয়ায় বানানো আমার sail করা আরেকটি জাহাজেও) কেবল সবচেয়ে সিনিয়র দু’জন অফিসারের দু’টো কেবিন – যে কেবিনগুলোর মুখ জাহাজের সামনের দিকে – সেগুলোতে এই বিশাল সাইজের port hole-গুলো লাগানো আছে। অন্য জাহাজের জানালা বা port hole-গুলোকে, চোখ/মুখ রেখে যেন অনায়াসে বাইরে তাকানো যায় – সে রকম উচ্চতায়ই স্থাপন করা হয়, তবে কাঁচের অংশটা বড়জোর কারো বুকের নীচ পযর্ন্ত বিস্তৃত থাকে। তাই কাউকে কেবিন থেকে বাইরের দৃশ্য (সমুদ্র বা deck) দেখতে হলে, জানালার বেশ কাছে যেতে হয়। কিন্তু দঃ কোরিয়ায় নির্মিত যে দু’টো জাহজের কথা বললাম, সেগুলোর port hole-গুলোর কাঁচের দৈর্ঘ/উচ্চতা এমন যে তা কোমরের নীচে পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। তাতে জীবন যাপনের ধরনের যে তারতম্য ঘটে, সেটা আমার কাছে রীতিমত “যুগান্তকারী” মনে হয়েছিল – কেবিনের যে কোন অংশ থেকে, এমনকি সোফায় বসেও কোন না কোন জানালা দিয়ে সমুদ্র তথা deck সার্বক্ষণিক দেখা যেত। ভাবতে অদ্ভূত লাগতো যে, কত সহজে আর কত অল্প ব্যয়ে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব। আরেকভাবে বলতে গেলে জীবনের ছোট ছোট ব্যাপরগুলোতেও এখনো improvement-এর কত অবকাশ রয়ে গেছে। এই একই ধরনের অনুভূতি হয়েছিল আরো দু’টো ব্যাপারে। প্রথমটি হচ্ছে “টুথ-ব্রাশ” সংক্রান্ত। “টুথ-ব্রাশ” মানুষ কতদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে? – হয়তো শতখানেক বছর?? কিন্তু ৯০-এর দশকে হঠাৎই Aquafresh এক বিশেষ ধরনের “টুথ-ব্রাশ” পেটেন্ট করে বাজারে ছাড়লো – মানুষকে বোঝালো যে, “টুথ-ব্রাশ”-এর আকৃতিটা ওরকম হলে তা মুখ-গহ্বরের প্রত্যন্ত অঞ্চল পরিস্কার করতে সক্ষম হবে। ব্যস কেউ কিছু বোঝার আগেই শত শত কোটি টাকা ঘরে তুললো তারা। এরকম আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে: আজকালকার মোমবাতিগুলোর নীচের অংশটা একটু বৃহত্তর পরিধির করে দেয়া হয়, যাতে তা আপনা আপনিই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রেও, আমার ভাবতে বেশ অবাক লাগে যে এই সামান্য বুদ্ধিটুকু মাথায় আসতে মানুষের কত যুগ সময় লেগেছে – মোমবাতির নীচের দিকটা আগুনে গলিয়ে মেঝেতে বা প্লেটে লাগাতে আমরা কত struggle-ই না করেছি!
এবার আসুন – গত পর্বের কিছু অসমাপ্ত আলোচনায়। জাহাজে মানুষের অসুখ বিসুখ নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। আমি নিজে জাহাজে ২ বার খুব মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। প্রথমবার ঘটনাটা ঘটেছিল করাচীতে। ঐ বার আমি প্রথম করাচী যাই – এবং আর সকল নাবিকের মতই, সেখানকার ক্লিফটন বীচে বেড়াতে যাই। যারা করাচী গিয়েছেন, তারা জেনে থাকবেন যে, উপ মহাদেশের বাহারী খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে (যেমন ধরুন তন্দুরী খাবার, চিকেন টিক্কা, কাবাবের যত জাত হতে পারে, কাড়াই গোস্ত, দই বড়া, চাট, পানিপুরী বা ফুচকা, কুলফি, লাস্সি, বিরিয়ানী ….name anything ) করাচী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর (অন্তত আমার taste-এ তাই)! আমরা ওখানে ১৫দিনেরও বেশী ছিলাম। যাহোক, ক্লিফটন বীচে গিয়ে দেখলাম ওখানে ফুচকা বিক্রী হচ্ছে। আমরা ঐ বার আমেরিকা ঘুরে, মধ্যপ্রাচ্য (দোহা, কাতার) হয়ে, দেশের পথে আসতে আসতে করাচীতে গিয়েছিলাম। দেশীয় অখাদ্য থেকে বলতে গেলে প্রায় ৬ মাস বঞ্চিত ছিলাম। ফুচকা দেখে মনটা হু হু করে উঠেছিল। প্রচন্ড ঝাল ও টক মিশ্রিত সেই ফুচকা যে খুব স্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিবেশন করা হয় নি – তা বলাই বাহুল্য! ব্যস জাহাজে ফিরে এসে “ফুড পয়জনিং” হেতু আমার প্রায় মারা যাবার অবস্থা – ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসে হুলুস্থূল অবস্থা। সেই থেকে রাস্তা-ঘাটে ফুচকা খাওয়ার মহাসুখটা জীবন থেকে চলে গেল। আজও ধানমন্ডি লেকের পারে বা ৭ নম্বর রোডের মোড়ে “মহুয়া” চটপটির দোকানের দিকে আমাকে কেবল সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকতে হয় – খাবার সাহস হয় না!
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটে সমুদ্রে – Hawaii থেকে কানাডার Vancouver BC যাচ্ছিলাম আমরা। এর আগে হাওয়াইতে ছিলাম প্রায় ১০/১২ দিন। ওখানে যে জায়গাটায় discharge হচ্ছিল তার নাম ছিল Barbers Point। তার পাশে একটা জঙ্গলা ঘাসের মাঠ ছিল – আর মাঠের ভিতর একটা শেডে ছিল ২ টা টেলিফোনের বুথ। জায়গাটা বেশ remote একটা অঞ্চলে ছিল – শহর থেকে অনেক দূরে । ওখান থেকে Honolulu-র Waikiki Beach এলাকায় যেতে প্রায় ৫০ ডলারের ট্যাক্সি ভাড়া লাগতো (মাফ করবেন: দুরত্বের আন্দাজ দিতে কথাটা বলা – show off করতে নয়) । Hawaii যওয়াটা যে কোন সাধারণ (particularly ঐ অঞ্চলের ট্রেডিং-এ নিয়োজিত নয়, এমন) নাবিকের জীবনে once in a life time ঘটনা। তাই আমরা সুযোগ পেলেই শহরে (Honolulu) বেড়াতে চলে যেতাম। আর অন্যকে বাইরে যাবার সুযোগ করে দিতে যেদিন বাইরে যাওয়া হতো না – সেদিন জাহাজের শত দু’এক গজের ভিতর অবস্থিত ঐ “অজো পাড়াগাঁর” ফোন বুথ থেকে বাড়ীতে কল করতাম – আর লম্বা সময় নিয়ে কথা বলতাম। হাওয়াইতে আমার দু’টো নতুন অভিজ্ঞতা হয়:
১) জাহাজী হিসাবে স্বল্পবসনা মেয়েমানুষ আমি জীবনে এর আগেও অনেক দেখেছি। কিন্তু Waikiki Beach-এ গিয়ে আমি রাসূল(সা.)-এঁর একটা হাদীসের অর্থ বুঝি – যেটা শুনে সালাফরা অবাক হয়েছিলেন, এটা ভেবে যে কাপড় পরা থাকা অবস্থায় আবার কেউ কিভাবে “নেংটো” হতে পারে! একটা সহীহ হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন:
Abu Huraira reported Allah’s Messenger (may peace be upon him) as saying: Two are the types amongst the denizens of Hell, ………….the women who would be naked in spite of their being dressed, who are seduced (to wrong paths) and seduce others…. [Sahih Muslim, Book 040, Number 6840]
২)Waikele Outlet Mall, Honolulu-তে গিয়ে আমি অবাক বিস্ময়ে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানখানা আবিষ্কার করি – আন্তর্জাতিক চেইন BORDERS-এর একখানা বিশা—-ল দোকান রয়েছে সেখানে। তবে “নতুন অভিজ্ঞতা” সেটা না। নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে ইসলামের উপর লেখা বেশ কিছু দুর্লভ বই আমি সেখান থেকে কিনি – আর সেখান থেকেই আমার “ইসলাম যাত্রার” দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হয়। রীতিমত “বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসার মত” একটা ব্যাপার।
যাহোক, গল্প বলতে লেগে আপনাদের নিয়ে অনেক দূর করে drift করে গিয়েছি (একটা জাহাজী অভিব্যক্তি ব্যবহার করে বসলাম আবার। কোথাও কোন কিছুর অপেক্ষায়, ইন্জিন বন্ধ করে ভেসে থাকার বেলায় আমরা drifting শব্দটা ব্যবহার করি। তখন হয়তো স্রোত বা বাতাসের প্রভাবে জাহাজটা মূল স্থান থেকে কোন দিকে বেশ খানিকটা সরে যায় – তখন আমরা বলি জাহাজটা অমুক দিকে drift করেছে।) ।
আমরা কথা বলছিলাম আমার জাহাজী জীবনের বড় অসুস্থতার দ্বিতীয় ঘটনাটা নিয়ে। ঐ যে মাঠের ভিতর ফোন বুথের কথা বলছিলাম! ওখানে গেলে খুব ছোট ছোট কিছু মশা আমাদের কামড়াতো বলে মনে হতো – আমার বাংলাদেশী চামড়ায় খুব একটা আপত্তিকর মনে হয় নি ব্যাপারটা। যাহোক, ঐ বন্দর থেকে জাহাজ sail করার ২/১ দিন পর থেকে, আমার থেকে থেকে জ্বর আসতে শুরু করলো কাঁপুনি দিয়ে – সঙ্গে মাথাব্যাথা। আমার বাঙালী মাথায় ম্যালেরিয়ার কথা আসলেও, আমার উপসগর্গুলো ঠিক পুরোপুরি ম্যালেরিয়ার সাথে মিলেও যাচ্ছিল না! জাহাজে যারা অসুখ বিসুখের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ তারাও বেশ confused হতে থাকলেন। ট্যালেক্স, ফ্যাক্স, রেডিও টোলিফোন, স্যাটেলাইট টেলিফোন (ইনমারসেট) ইত্যাদির মাধ্যমে চললো চিকিৎসকদের উপদেশ গ্রহণের বিবিধ প্রচেষ্টা। জ্বরের মাত্রা (১০৪~১০৫) ও ব্যাপ্তি বাড়তেই থাকলো, প্যারাসিটামল জাতীয় এনালজেসিকের কার্যকারিতা কমতে থাকলো, আমার অবস্থার উত্তেরোত্তের অবনতি ঘটতে থাকলো – আমি একেবারে অকর্মণ্য হয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম। জাহাজে প্রত্যেকের well defined কাজ থাকে – কাজের line-up-এ ছেদ পড়ায় অসুবিধা যেমন হয়, তেমনি যিনি তার ভূমিকা পালন করতে পারেন না, তারও খুব অপরাধ বোধ হয়। আমি জাহাজের সিনিয়রতম rank-এর একজন হওয়াতে, কিছু বাড়তি privilege যেমন ছিল, তেমনি কিছু অপরিহার্যতাও ছিল। তাই আমার ঠিক নীচে যে ঘানিয়ান অফিসার ছিল, সে সময় সময় এসে কাগজপত্র, হিসাব নিকাশ ও প্রতিদিনোর মধ্যাহ্ন রিপোর্টের ম্যাসেজ ইত্যাদি দেখিয়ে নিত। এই ব্যাপারগুলো জাহাজের দুই বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র ২ জন অফিসারই সব সময় deal করেন বলে, অন্যরা তা করতে গেলে হিম শিম খান। এই অভিজ্ঞতা আমার আর আগে কখনো হয় নি। যা হোক যতদূর মনে পড়ে শ্লথ Bulk Carrier-এর জন্য বন্দর থেকে বন্দরে যেতে লেগেছিলো প্রায় ৭ দিন। Vancouver BC পৌঁছালে আমাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। এক ইহুদী ডাক্তার দেখলেন এবং উপসর্গ নিয়ে তিনিও বেশ confused – তাছাড়া, Hawaii-তে ম্যালেরিয়াবাহী মশা থাকা সম্ভব নয় – এটা ছিল তার বদ্ধমূল ধারণা, কারণ Hawaii, USA-র অংশ । তিনি আমার বিগত মাস দু’য়েকের অবস্থানের খোজ খবর নিলেন। উপসর্গ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হতে পেরে, তিনি আমাকে হাসপাতালে পাঠাবেন কিনা ভাবতে ভাবতে বললেন একটা ইউরিন টেস্টের স্যাম্পল দিতে। আমি স্যাম্পলটা দিয়ে মাঝখানের সময়টা কাছেরই একটা Seamen’s Club-এ গিয়ে কিছু বই ঘেঁটে কাটালাম। বিকাল ৫ টার আগে আগে ডাক্তার সাহেবের কাছে ফিরে আসলে তিনি নিশ্চিত করলেন যে, আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে। তবে তিনি দুই ধরনের ঔষধ দিলেন – বললেন, “ম্যালেরিয়ার দু’টি ধরন রয়েছে।” তার জানামতে Hawaii-তে ম্যালেরিয়ার কোন ইতিহাস নেই। তাই তিনি নিশ্চিত নন আমারটা কোন ধরনের। ঐ দু’টো ঔষধ আমাকে সার্বিক সুরক্ষা দেবে বলে বললেন তিনি। ঐ দিনই শেষ রাতে আমরা sail করলাম Panama Canal-এর উদ্দেশ্য – চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল ইউরোপ – কিন্তু নির্দিষ্ট বন্দরটি তখনো অজানা ছিল। ঔষধ সেবনের পরের ২৪ ঘন্টার মাঝেই আমার অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করলো । কিন্তু ঔষধের কোর্স শেষ হবার পর পর, আবার মনে হলো জ্বরটা ফিরে আসছে। জাহাজ থেকে তখন নরোওয়ের একটা “রেডিও মেডিক্যাল সার্ভিসের” সাথে যোগাযোগ করা হলো। তারা আরো কিছু উপদেশ দিয়ে বললো observe করতে, যদি বেগতিক দেখা যায়, তবে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, এরকম কিছু বললো। কোম্পানীও ঘন ঘন খবর নিতে শুরু করলো in case যদি আমাকে Panama-য় নামাতে হয়, তবে তার প্রস্তুতির জন্য। যাহোক, পানামা পৌঁছার আগেই আমার সকল উপসর্গের উপশম হয়েছিল – আলহামদুলিল্লাহ্!