সমুদ্রে জীবন – ১১
সে বার ছোট বুশ প্রথম যখন নির্বাচনে জেতেন, তখন আমরা ছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার Oakland-এ। আমি বাইরেও গিয়েছিলাম, কিন্তু রাস্তাঘাটে এমন কিছুই চোখে পড়ে নি, যা দেখে মনে পড়বে যে নির্বাচন চলছে। আর কন্টেইনার জাহাজের স্বল্প সময়ের বন্দর উপস্থিতির মাঝে কেউ টেলিভিশন দেখে না। যা হোক, নির্বাচনের পরের দিন ভোরে আমরা Oakland থেকে sail করলাম Taiwan-এর Kaohsiung বন্দরের উদ্দশ্যে। জাহাজকে বন্দর থেকে, বাইরে অর্থাৎ সমুদ্রে রেখে আসতে একজন Pilot যথারীতি জাহাজে এলেন।
যারা নতুন নতুন আমাদের কাছ থেকে জাহাজী গল্প শুনছেন, তাদের অবগতির জন্য বলছি যে, যে কোন বন্দরে, যে কোন বার্থে যাবার জন্য ঐ বন্দরের কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি, বহির্নোঙরে বা সমুদ্রেই জাহাজে আরোহন করেন – পথ-দেখিয়ে-নিয়ে-যাওয়া ঐ সব লোককে জাহাজী ভাষায় Pilot বলা হয়। সাধারণত দ্রুতগামী Pilot Boat-এ করে এসব Pilot-রা সমুদ্রের গভীরে ২/১ মাইল থেকে শুরু করে অনেক সময় প্রয়োজনে ৮/১০ মাইল দূরে গিয়ে জাহাজে ওঠেন – অথবা – বন্দর ছেড়ে যাবার সময় তারা বার্থে এসে জাহাজে ওঠেন, তারপর জাহাজটাকে সমুদ্রে নিরাপদ দুরত্বে নিয়ে গিয়ে, সেখানে জাহাজ থেকে নেমে অপক্ষমান Pilot Boat-এ করে আবার বন্দরে ফিরে আসেন । সমুদ্রের অবস্থা খারাপ থাকলে অনেক সময় এরা হেলিকপ্টারে করেও জাহাজে আসেন বা জাহাজ থেকে ফিরে যান। আমার অভিজ্ঞতায়, আমার জাহাজে অনেকবারই Rotterdam/Euro-port-এ হেলিকপ্টারে করে Pilot এসেছেন বা জাহাজ থেকে নেমে গিয়েছেন! কখনো কখনো গভীর সমুদ্র বা একটা এলাকার জন্য Pilot নেয়া হয় – যেমন আমরা English Channel তথা North Sea-র জন্য North Sea Pilot নিতাম UK-র Brixham থেকে। Brixham-এর British Pilot-রা ছাড়াও, North Sea Pilot-এর জন্য, আরো অন্যান্য দেশের Pilot এজেন্সী রয়েছে – তবে আমার গত কোম্পানীতে আমরা সব সাধারণত Brixham-এর British Pilot-দেরই নিতাম, কেবল একবার একটা Dutch কোম্পানী থেকে কোন বিশেষ কারণবশত একজন Dutch Pilot নেয়া হয়েছিল, যিনি জাহাজে উঠেছিলেন, Brixham-এর উল্টো দিকের ফরাসী উপকূল থেকে। এই North Sea Pilot-রা আমাদের সাথে প্রায় সপ্তাহখানেক জাহাজেই থাকতেন – আমরা ইউরোপের load/discharge শেষ পর্যায়ে যখন শেষ বন্দরে আসতাম, তখন তারা সেখান থেকে বিদায় নিতেন। আমাদের কোম্পানীর লাইনার জাহাজগুলোর জন্য ফ্রান্সের Le Havre। Pilot-দের অনেকের সাথেই আমাদের বার বার দেখা হতো এবং বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতো। আমরা আমেরিকা থেকে ইউরোপ গেলে, নিউ ইয়র্ক থেকে sail করার ৬/৭ দিন পর ইংলিশ চ্যানেলের মুখে Brixham-এ পৌঁছাতাম। ইংল্যান্ডের মেঘলা আকাশের পটভূমিতে Brixham-এর উপকূলের দৃশ্যটাই বেশী মনে পড়ে – আজ মনে হয় সব সময়ই যেন জায়গাটাকে মেঘাচ্ছন্ন আর কুয়শাচ্ছন্নই দেখেছি। আসলে হয়তো তা না – তবে ঐ স্মৃতিটাই মনে জেগে আছে ও মনে করতে চাইলে ঐ ছবিটাই ভেসে ওঠে! Brixham-এর কাছাকাছি পৌঁছালে, জাহাজের ইন্জিনটা যখন slow down করা হতো, মনটা তখন এমনিতেই খুশী হয়ে উঠতো। উত্তর আটলান্টিকে ৬/৭ দিন একটানা যাত্রার পর ঐ মাটি দেখাটা মনটাকে উৎফুল্ল করে দিত। এছাড়া আরো একটা ছোট্ট ব্যাপারও হয়তো খুশীতে যোগ হতো – নিয়ম অনুযায়ী এসব Pilot-রা তাদের এজেন্সীর তরফ থেকে কয়েক বান্ডিল খবরের কাগজ নিয়ে আসতেন – দিনের খবরের কাগজ ছাড়াও বিগত এক সপ্তাহের পুরানো খবরের কাগজ, ট্যাবলয়েড, সাময়িকী ইত্যাদি থাকতো! যাহোক জাহাজে Pilot-ওঠানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, এক সময় ইন্জিন থামিয়ে আমরা উপকূল থেকে কিছু দূরে Pilot-এর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে drift করতাম। যাদের কাছে উপযুক্ত cell phone থাকতো, তারা UK-তে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সাথে কথা-বার্তা বলতো। আমি নিজেও ২/১ বার লন্ডনে আমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে program fix করেছি – কবে UK-র বন্দরে যাচ্ছি, আর সেখান থেকে কবে কখন লন্ডনে তাদের দরজায় পৌঁছাবো “হাতকরা” আর বীফের তরকারি -অথবা- শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে। Pilot-এর গল্পের আরেকটু বলার আছে – কিছু জায়গায় মানুষ বুদ্ধি করে খাল কেটে, দু’টো জলরাশিকে সংযুক্ত করে জাহাজ চলাচলে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে! এরকম জায়গার লিস্টের শীর্ষে থাকবে Panama Canal, Suez Canal ও Kiel Canal – যদিও এদের প্রখম ২টির মত আলোচিত বা অপরিহার্যও নয়। Panama Canal ও Suez Canal কতবার পারাপার করেছি তা হসাব করতে পারবো না, তবে Keel Canal-পার হয়েছি মাত্র ১ বার – Poland-এর Gdansk থেকে জার্মানীর Bremen/Hamburg-এ আসতে গিয়ে আমরা Kiel Canal-এর ভিতর দিয়ে এসেছিলাম।
যাহোক Pilot-এর গল্প বলতে বলতে আপনাদের নিয়ে অনেকটা drift করে গিয়েছি। ইউরোপের গল্প আরেকদিন হবে। আজ ফিরে যাই ক্যালিফোর্নিয়ার Oakland-এ। আপনারা জানেন ক্যালিফোর্নিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উদার স্টেটগুলোর একটা – এখানকার মানুষজন যে কোন ethnic group, sect বা cult-এর প্রতিই সহানুভূতিশীল – তা রেড ইন্ডিয়ান হোক, লেসবিয়ান বা গে হোক, হিপ্পি হোক আর মুসলিমই হোক। এখানে প্রচুর উদারপন্থী ও বামপন্থীদের বসবাস। তাছাড়া এখানে এত হিসপ্যানিক আর বিদেশীরা এসে settle করেছে যে, হালে সাদা-চামড়ারা এখানে সংখ্যাগরিষ্টতা হারিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সেই উদারতার ধারাবাহিকতায়, এখানকার Pilot-দেরও আমার বেশ দিল-খোলা মনে হয়েছে। ঐ দিন মধ্যবয়স্ক Pilot ব্রীজে এসেই জিজ্ঞেস করলো, “দেখলে কাল কি হয়ে গেলো – আমেরিকা আর তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশের ভিতর কোন তফাৎ থাকলো না । প্রথমে বলা হলো এ্যাল গোর নির্বাচন জিতেছে – তারপর কিভাবে সেটা বদলে গেলো। এখানে সবই টাকার খেলা – সব প্রার্থীরাই বিলিওনিয়ার। এই ধরনা এ্যাল গোরের কথা – সে অক্সিডেন্টালের মেজর শেয়ার হোল্ডার!” অক্সিডেন্টালের কথা শুনে আমার বাংলাদেশী কান, খাড়া হয়ে গেল। জানলাম আমার দেশের এবং আরো ক্ষুদ্র পরিসরে আমার জেলার, মাগুরছড়া-পোড়ানো অক্সিডেন্টালের মুখ্য শেয়ার হোল্ডার হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট তথা সেবারের প্রেসিডেনশিয়াল ক্যান্ডিডেট এ্যাল গোর। এরও বহু পরে, পরিবেশবাদী কর্মী হিসাবে এ্যাল গোরকে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা হয়েছিল – জাপানে দারুন রকমের সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল মাগুরছড়া-পোড়ানো অক্সিডেন্টালের মুখ্য শেয়ার হোল্ডার আর Kyoto Protocol-এ স্বাক্ষর না করা দেশ, যুক্তরাষ্ট্রের, প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট এ্যাল গোরকে। এভাবেই পৃথিবীটা চলছে – জাহাজ কোম্পানীগুলোর মালিকরা ও তাদের flag stateগুলোর port state control যখন পরিবেশ রক্ষার জন্য চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জাগিয়ে রাখছে – তৃতীয় বিশ্বের জাহাজগুলো পরিবেশ দূষণের জন্য অভিযুক্ত ও জরিমানা দেবার ভয়ে উন্নত বিশ্বের বন্দরে যেতে ভয় পাচ্ছে, তখনই ছোট ছোট “খেলোয়াড়”দের খেলা থেকে বাদ দিতে চলছে প্রতিযোগিতার উন্মাদনা! প্রতিদিন জাহাজ প্রতি ১৮৫ টন জ্বালানী ব্যবহার করতে গিয়ে বায়ূ মন্ডলে যোগ করা হচ্ছে বি..শা…ল পরিমাণ মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী গ্যাস সমূহ – কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেনের বিষাক্ত সব অক্সাইড – সমৃদ্ধ exhaust গ্যাস।
সমুদ্র থেকে Oakland-এর বার্থ অথবা Oakland বার্থ থেকে সমুদ্র এই পথটুকু আমার খুব প্রিয় ছিল – কতবার যে অতিক্রম করেছি তা আল্লাহই জানেন। বন্দরে যাবার সময় আমাদের জাহাজ San Francisco-র বিখ্যাত Golden Gate Bridge-এর নীচ দিয়ে এগিয়ে যেতো San Francisco শহরের পর্যটন-আকর্ষণ Fisherman’s Wharf কে ডানপাশে রেখে আর “দ্যা রক” খ্যাত Alcatraz নামক দ্বীপকে বাঁ পাশে রেখে। তারপর আমরা যেতাম San Francisco ও Oakland-কে সংযোগকারী Oakland Bay Bridge-এর নীচ দিয়ে। এরকম জায়াগা থেকে স্কাই-লাইন সহ গোটা San Francisco শহরটাকে ছবির মত দেখা যেতো – এবং আমার জ্ঞানমতে এটাই ঐ শহরের সবচেয়ে ভালো/সুন্দর view – বহু ছবি তথা ওয়ালপেপারে আমি San Francisco শহরের এই viewটাই দেখেছি। আমরা যখন Oakland থেকে সমুদ্রে ফেরত যেতাম তখন আবার Fisherman’s Wharf এবং Alcatraz
দু’টোকেই হাতের বাইরে রেখেবাইরে দিয়ে” আমরা এগিয়ে যেতাম Golden Gate Bridge-এর দিকে।
Oakland আমাদের একরকম Home Port হয়ে গিয়েছিল – অথচ আমি/আমরা Oakland শহরে খুব কমই বেড়াতে যেতাম। আমি সাধরনত যেতাম ১ ঘন্টারও বেশী সময় ট্রেনের যাত্রাপথ পেরিয়ে Fremont বলে একটা জায়গায় আর – তা না হলে একদম উল্টো দিকে San Francisco-তে যেতাম। যারা San Francisco-র Bay Area-তে চলাফেরা করেছেন, তারা জেনে থাকবেন যে ঐ সব জায়গায় চলাফেরার এক comfortable উপায় হচ্ছে ওখানকার নগর রেল – যেটাকে তারা BART (Bay Area Rapid Transport) বলে থাকে। এই রেলপথটা কখনো San Francisco Bay-র পানির নীচের সূড়ঙ্গ দিয়ে চলে – আবার কখনো সমতল ভূমির উপর দিয়ে চলে আবার কখনো বা এলিভেটেড রেল হিসেবে চলে – যেখানে যে রকম সুবিধা! লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে – San Francisco Bay Area-র গল্প না হয় আরেকদিন বলা যাবে!
[এই জাহাজটা এবং এর sister ship-এ করে আমি বহুবার San Francisco Bay Area তে গিয়েছি।]