প্রশ্নঃ মানুষ কোন কোন অবস্থায় কুরআন, দু’আ ,দুরুদ পড়া ও যিকির করতে পারবে না?

উত্তর  দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ

উত্তরঃ ধন্যবাদ আপনাকে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু প্রশ্নটি আসলে কমন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ দু’আ, দরুদ, যিকির এবং কুরআন তিলাওয়াতকে একসাথ করে দিয়েছেন। কুরআনে কারীমের তিলাওয়াতের বিধান দু’আ, দরূদ এবং যিকিরের বিধানের চেয়ে ভিন্ন। এটা আমাদের ভালোভাবে জানতে হবে। কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত পবিত্র অবস্থায় করাটাই হচ্ছে কুরআনে কারীমের আদব৷ তাই যদি কেউ কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত করতে চান তাহলে তিনি ত্বহারাত অবস্থায় কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করবেন। অর্থাৎ যদি গোসল ফর‍য হয়ে থাকে তাহলে তিনি গোসল করে নিবেন আর যদি অযুর প্রয়োজন হয়ে থাকে তাহলে তিনি অযু করে নিবেন। তারপর কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত করবেন; এটি কুরআনে কারীমের ‘আদব এবং উত্তম কাজ। এ বিষয়ে ‘আলেমদের সামান্যতম কোনো দ্বিমত নেই। তবে যদি কোনো ব্যক্তির অযু নষ্ট হয়ে যায় যেটিকে হদসে আসগর বা ছোট অপবিত্রতা বলা হয়ে থাকে তাহলে তিনি কি কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন কিনা এ বিষয়ে অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য হচ্ছে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন, কুরআন তিলাওয়াত করতে কোনোধরনের বাধা নেই৷ যেহেতু এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সুস্পষ্ট কোনো হাদিসের মধ্যে এ নিষেধাজ্ঞা আসেনি। তাই এ কাজটি তিনি করতে পারবেন।

তৃতীয় যে মাস’আলাটি এখানে আসবে সেটি হচ্ছে যদি কেউ এ অবস্থায় চলে যায় যে তার উপর গোসল ফরয হয়ে গিয়েছে অর্থাৎ জুনুব অবস্থায় যিনি রয়েছেন তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন কিনা এ মাস’আলাটি নিয়ে ‘আলেমদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। একদল ‘উলামায়ে কিরাম এটি বলেছেন যে জুনুব ব্যক্তি অর্থাৎ যার উপর গোসল ফরয হয়েছে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন না। কুরআন তিলাওয়াত করা তার জন্য জায়েয নেই। এটি চার মাযহাবের সমস্ত ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য এবং সাহাবায়ে কিরামদের অধিকাংশের বক্তব্য এটি। এ বিষয়ে, ইমাম তিরমিযী (রহ.) তার সুনানের মধ্যে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

وهوقول اكثر اهل العلم من اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم والتابعين

“এটি রাসূল ﷺ এর সাহাবীদের মধ্য থেকে অধিকাংশ ‘আলেমের বক্তব্য এবং তাবে’ঈদের অধিকাংশ ‘আলেমের বক্তব্য যে যুনুব অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা যাবে না৷” এ বিষয়ে ‘আলী ইবনে আবি ত্বলিব রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহুর একটি হাদিস বর্ণনা করা হয়ে থাকে দলিল হিসেবে। ‘আলী ইবনে আবি ত্বলিব রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন,

ولم يكن يحجبه عن القرآن شيئ ليس الجنابة

“যে অপবিত্রতার কারণে গোসল ফর‍য হয় এই অপবিত্রতা ছাড়া আর কোনো কিছুই রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে কুরআন তিলাওয়াত থেকে বাধা দিত না।” এখান থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ্ ﷺ অপবিত্র হলে কুরআন তিলাওয়াত করতেন না। (মুসনাদ আহমাদ ১০১১, আবু দাউদ ২২৯, নাসাঈ ২৬৫, ইবনে মাজাহ ৫৯৪)। এ হাদিসটিকে একদল ‘উলামায়ে কিরাম সহিহ বলেছেন আবার আরেকদল ‘উলামায়ে কিরাম যয়ীফ বলেছেন অর্থাৎ এ হাদিসের সনদের বিশুদ্ধতা নিয়ে ‘আলেমদের মধ্যে ইখতিলাফ আছে। এছাড়া এখানে এই হাদিস ছাড়াও অনেকগুলো হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে যার সবগুলোই সনদের দিক থেকে বিতর্কিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। শুধুমাত্র এ হাদিসটিকে বেশিরভাগ ‘উলামায়ে কিরাম সহিহ বলেছেন এবং এটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন৷ এই মাস’আলার মধ্যে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তিনিও বলেছেন যে, “এটিই হচ্ছে অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য আর এটিই বিশুদ্ধ বক্তব্য যে, যার উপর গোসল ফরয হয়েছে তিনি কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করবেন না।” এক্ষেত্রে ইবনে কুদামা (রহ.) তার মুগনীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

“জুনুব ব্যক্তি যার উপর গোসল ফরয হয়েছে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করবেন না, ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু বলেন,

জুনুব ব্যক্তি তার সুনির্দিষ্ট কুরআন থেকে যে তিলাওয়াতটুকু রয়েছে নিয়মিত সেটি করতে পারবেন। ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে এই রেওয়াতের কারণেই মূলত পরবর্তীতে ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে যেটি সাহাবীদের প্রথম সময়ে মতবিরোধপূর্ণ ছিল না। ইবনে ‘আব্বাস (রা.) এই বর্ণনাটি ইমাম বুখারি (রহ.) তার সহিতে তা’লীক বর্ণনা করেছেন। সেটা হচ্ছে ইমাম বুখারি (রহ.) বর্ণনা করেন,

ولم ير ابن عباس رضي الله عنه بالقراءة للجنب بأسا

“ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু যার উপর গোসল ফরয হয়েছে তার কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসুবিধা মনে করতেন না।” ইমাম বুখারি (রহ.) এর এই বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু জুনুব ব্যক্তিকে কুরআন তিলাওয়াতের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে যদি সমস্ত রেওয়াতগুলো একসাথ করা হয়ে থাকে সেখান থেকে আমরা স্পষ্টকরে বুঝতে পারি ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু শুধুমাত্র উইর্দের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেটি বান্দা নিয়মিত তিলাওয়াত করে থাকেন সেগুলোর অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু কুরআন তিলাওয়াতের বিষয়টি মূলত ইবনে ‘আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু সাধারণত অনুমতি দেননি। আহলুল হাদিসগণ ইবনে ‘আব্বাস (রা.) বক্তব্য থেকে এটিই বুঝেছেন। জুনুব ব্যক্তির কুরআন তিলাওয়াত না করাটাই হচ্ছে বিশুদ্ধ বক্তব্য। এর সাথে সম্পৃক্ত হবে হায়েজ বা ঋতুবর্তী মহিলার মাস’আলাও। তারাও কুরআন তিলাওয়াত থেকে দূরে থাকবেন। তবে হায়েজের ক্ষেত্রে ‘উলামায়ে কিরাম একটি বক্তব্য দিয়েছেন সেটি হচ্ছে, যেহেতু তার হায়েজের এই সময়টি দীর্ঘায়িত হতে পারে তাই যদি তিনি কুরআনে কারীমের হাফেয হোন অথবা তার উইর্দ বা নিয়মিত তিলাওয়াত যেগুলো রয়েছে সেগুলো যদি ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তিনি সে আয়াতগুলো মুরাজাআ করতে পারবেন অর্থাৎ রিপিট করতে পারবেন। এটি তার জন্য জায়েয রয়েছে মর্মে একদল ‘উলামায়ে কিরাম ফাতাওয়া দিয়েছেন।

কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া অন্য যে যিকিরগুলো রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে ‘আয়িশা রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহার হাদিস থেকে বুঝা যায়,

عن عَائِشَةَ رضي الله عنها، قَالَتْ: “كَانَ النَّبِيُّ – صلى الله عليه وسلم – يَذْكُرُ الله عَلَى كُلِّ أَحْيَانِهِ”

“নবী ﷺ সর্বাবস্থায় যিকির করতেন।”(সহিহ মুসলিম) তাই এই হাদিস থেকে আমরা বলতে পারি যে, যিকির অর্থাৎ আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের তাসবিহ, তাহলিল, তাহমীদ সর্বাবস্থায় করা জায়েয আছে। এগুলোর জন্য ত্বহারাত শর্ত নয়। সুতরাং কোনো বান্দা যদি আল্লাহর যিকির করতে চান তাহলে তিনি সবসময় করতে পারবেন। সেটাই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে কারীমের সূরা ‘আলে ইমরানের ১৯১ নং আয়াতে বলেছেন,

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ

“তারা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের যিকির দাঁড়ানো, বসা এবং শোয়া অর্থাৎ সর্বাবস্থাতেই করে থাকে।” আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রশংসা করেছেন। সুতরাং যিকিরের জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সুনির্দিষ্ট কোনো ধরন, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য অথবা কোনো ধরনের নিয়ম নির্ধারণ করে দেননি। বরং আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বান্দাদের সুবিধার জন্য অর্থাৎ যিকির যেন আল্লাহর বান্দা সার্বক্ষণিক করতে পারেন এজন্য বান্দাকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সুযোগ দিয়েছেন এবং অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সবাইকে বিষয়গুলো উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *