প্রশ্নঃ অনেকেই কুরআন মাজীদ নিজের মন মত করে ব্যখ্যা করছেন অর্থাৎ তাফসীর করছেন। এখন এরকম লোকদের কিভাবে দাওয়াত দিব সঠিক বুঝের দিকে?

উত্তর  দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ

উত্তরঃ ধন্যবাদ আপনাকে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছেন। প্রথমত, আজকাল আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি যেখানে মুফতি অনেক বেড়ে গিয়েছে, মুফাসসির অনেক বেড়ে গিয়েছে, ফকীহ্ অনেক বেড়ে গিয়েছে। আজকাল ডিজিটাল মুফতি পাওয়া যায় যিনি কিনা একটু ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে এখন ডিজিটাল মুফতি হয়ে গিয়েছেন। তাছাড়া এখন অনেক ফকীহ নেট পাওয়া যায় অর্থাৎ ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করে তিনি ফকীহ নেট হয়েছেন; কোনো ‘আলেমদের কাছে পড়ালেখা করেন নি, কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন নি এবং শরিয়ার জ্ঞান এক্ষেত্রে খুবই সামান্য। হয়তো কিছু ভাষাগত জ্ঞান রয়েছে তার উপর নির্ভর করে এবং ফেসবুক, হোয়াটস এপ, ইউটিউব ইত্যাদি এগুলোর উপর নির্ভর করে তারা মুফতি হয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদেরকে আমরা অনেকেই শাইখ হিসেবে লকব দিচ্ছি। আসলে তাদের অনেককে শাইখতো দূরের কথা; জাহেল বলাও অনেক কষ্টকর। জাহেল বলা জায়েয হবে কিনা আমি সন্দেহ পোষণ করি। এ ধরনের লোকদেরকে আজকাল শাইখ বলা হয়ে থাকে। আবার তাদের অনেকের লকব ‘আল্লামা, তাদের মধ্যে অনেকে এমন আছেন যারা জানেন না যে ‘আল্লামা শব্দের অর্থ কি। এদের মধ্যে অনেকেই মূলত কুরআনকে নিজের খায়েশ বা ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। এই কাজটি সম্পুর্ণরূপে হারাম, গর্হিত এবং কবীরা গুনাহ্। আমরা যদি আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের কালামের দিকে দেখি তাহলে আমরা স্পষ্ট হবো। সূরাতুল আ’রাফের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,

وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

“আর তোমরা আল্লাহ্‌ তা’আলার উপর এমন মিথ্যারোপ করবে যেটা তোমরা জানো না।” আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন সম্পর্কে কেউ যদি এমন কথা বলে না জেনে তাহলে সে কিন্তু আল্লাহ্‌ তা’আলার উপর মিথ্যারোপ করলো। আর এই অপরাধটি শিরকের পরে যেই অপরাধগুলো রয়েছে তার মধ্যে একটি। সুতরাং, আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের নামে এ ধরনের বক্তব্য কেউ যদি নিজের প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ্ করলেন। আমরা দেখতে পাই আবু বকর রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহুকে যখন সামান্য একটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো, “ফাকিহাতাও ওয়া আব্বা” এই আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করা হলো তখন আবু বকর রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু কিছু বললেন না, চুপ থাকলেন। যেহেতু সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে এর কোনো ব্যাখ্যা জানতে পারেননি। তাকে বলা হলো আপনি বলতে পারেন। তখন তিনি উত্তরে বললেন,

اي ارض تقلني اي سماء تظلني اذا قلت في آية من كتاب الله برأي او بما لا اعلم

“কোন আকাশ আমাকে ছায়া দিবে, কোন জমিন আমকে আশ্রয় দিবে যদি আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের কিতাব থেকে কোনো একটি আয়াতের ব্যাপারে আমার ইচ্ছামতো কথা বলি অথবা যেটি আমি জানিনা সেটি বলি।” এতে কোনোসন্দেহ নেই আবুবকর রাদি’আল্লাহু ‘আনহু জন্ম থেকে ‘আরবী ভাষা জানেন। আরবের একটি শিশুও ফাকিহা শব্দের অর্থ জানেন, আব্বা শব্দের অর্থ আরবের ঐ জাহেলি সমাজে জানেন না এমন কেউ ছিল না। এতদসত্তেও আবু বকর রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহু এই আয়াতের ব্যাখ্যা যেহেতু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জানেন নি তাই তিনি চুপ ছিলেন। তিনি এর ব্যাখ্যা দেননি। এখান থেকে প্রতিয়মান হয় যে, কুরআনে কারীমের ব্যাখ্যা খায়েশমতো বা বিবেকমতো যারা দিচ্ছেন তারা সবচেয়ে বড় গুনাহে লিপ্ত রয়েছেন এবং একাজটুকু তাদের জন্য জায়েয নেই। আসুন দেখি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেছেন। ইমাম তিরমিযী (রহ.) এই হাদিসটিকে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি হাসান বলেছেন। আহলুল তাহক্বীকদের মধ্যে একদল ‘উলামায়ে কিরাম এটিকে হাসান এবং সহিহ বলেছেন।

من قال في القرآن برأيه فليتبوأ مقعده من النار وفي لفظ بغير علم

“যে ব্যক্তি কুরআনের মধ্যে না জেনে বললো ব্যাখ্যা দিল (রাসূল থেকে অথবা সাহাবীদের থেকে) সে যেন জাহান্নামে নিজের স্থানকে নির্দিষ্ট করে নেয়।”

কোনো কোনো রেওয়ায়াতের মধ্যে এসেছে যে ব্যক্তি নিজের ধারনা অনুযায়ী অথবা প্রবৃত্তি অনুযায়ী ব্যাখ্যা দিল সে যেন নিজের স্থানকে জাহান্নামে করে নেয়।

সুতরাং কোনোভাবেই এটিকে সহজ ভাবার কোনো সুযোগ নেই, নিজের প্রবৃত্তি অনুযায়ী ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য ইমাম মাসরুক ইবনে আজদা আল রুয়াইসী (রহ.) বলেন,

اتقوا التفسير فانما هو الرواية عن الله

“তোমরা তাফসীরের ব্যাপারে সতর্ক হও, যেনে রাখো তাফসীর হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণনা করা।” সুতরাং তুমি আল্লাহ্ সম্পর্কে যে বর্ণনা দিচ্ছো এক্ষেত্রে তোমার কি জ্ঞান রয়েছে? তুমিকি তোমার প্রবৃত্তি অনুযায়ী বর্ণনা দিচ্ছো। যদি এটি হয়ে থাকে তাহলে এটি সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তিকর এবং আল্লাহ্‌ তা’আলার উপর মিথ্যারোপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যারা কুরআনের ব্যাপারে নিজেদের খায়েশমতো বক্তব্য দিচ্ছেন তারা আল্লাহ্‌ এবং তার রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করছেন, তারা বড় কবীরা গুনাহে লিপ্ত রয়েছেন। সতর্ক হওয়ার সময় রয়েছে। আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন আমাদেরকে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে সতর্ক রাখুন এবং আমাদেরকে বিষয়টি উপলব্ধি করে এ ধরনের কাজ থেকে সতর্কতা অবলম্বন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *