জমজমের পানি কি দাড়িয়ে পান করা আবশ্যক? জমজমের পানি পানের সুন্নাহ সম্পর্কে জানতে চাই বিস্তারিত?
প্রশ্নঃ জমজমের পানি কি দাড়িয়ে পান করা আবশ্যক? জমজমের পানি পানের সুন্নাহ সম্পর্কে জানতে চাই বিস্তারিত?
উত্তর দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
উত্তরঃ ধন্যবাদ। আসলে আমরা প্রথমে পানি পান করার সুন্নাহ্ সম্পর্কে এবং পরবর্তীতে জমজমের পানি পান করার সুন্নাহ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু নীতিমালা আপনাদেরকে দিতে চাই যাতে করে এ বিষয়ে আমাদের আর প্রশ্ন না থাকে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো নিচে তুলে ধরা হলো। তারপর আমরা মাস’আলাটি বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্। প্রথমত, ইমাম মুসলিম (রহ.) তার সহিতে বর্ণনা করেছেন হাদিস নং ২০২৪ ও ২০২৫। একটি আনাস ইবনে মালিক রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে এবং অপরটি আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَنَسٍ وأَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رضي الله عنهما أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَجَرَ (في لفظ : نَهَى) عَنْ الشُّرْبِ قَائِمًا
“নবী ﷺ দাঁড়িয়ে পানি পান করাকে নিষেধ করেছেন।” এবং এই বক্তব্যটুকু নবী ﷺ এর সহিহ সনদে সাব্যস্ত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُما قَالَ : سَقَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ زَمْزَمَ فَشَرِبَ وَهُوَ قَائِمٌ
“আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জমজমের পানি পান করিয়েছি। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ দাঁড়িয়ে জমজমের পানি পান করেছেন। (বুখারি ১৬৩৭, মুসলিম ২০২৭)
এ হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জমজমের পানি পান করানো হয়েছে এবং তিনি দাঁড়িয়ে এটি পান করেছেন।
তৃতীয় হাদিসে আমরা দেখি ‘আলী ইবনে আবু তালিব রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত,
عن عَلِيّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أنه شَرِبَ قَائِمًا ثم قَالَ : إِنَّ نَاسًا يَكْرَهُ أَحَدُهُمْ أَنْ يَشْرَبَ وَهُوَ قَائِمٌ ، وَإِنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَ كَمَا رَأَيْتُمُونِي فَعَلْتُ
একদিন ‘আলী ইবনে আবি ত্বলিব দাঁড়িয়ে পানি পান করলেন (কেউ কেউ বলেছেন এটি হজ্বের সাথে সম্পৃক্ত একটি ঘটনা)। তারপর তিনি বলেছেন যে একদল লোককে আমরা দেখতে পাই যারা দাঁড়িয়ে পানি পান করাকে অপছন্দ করে থাকেন। অথচ, আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে দেখেছি এমনটি করতে যেমনটি আমি করেছি। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে আমি দাঁড়িয়ে পানি পান করতে দেখেছি তাই আমি দাঁড়িয়ে পানি পান করলাম। (বুখারি ৫৬১৫)
৪র্থ হাদিসে আমরা দেখতে পাই, এটিও ‘আলী রাদি’আল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ شَرِبَ قَائِمًا ، فَنَظَرَ إِلَيْهِ النَّاسُ كَأَنَّهُمْ أَنْكَرُوهُ فَقَالَ : مَا تَنْظُرُونَ ! إِنْ أَشْرَبْ قَائِمًا فَقَدْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَشْرَبُ قَائِمًا ، وَإِنْ أَشْرَبْ قَاعِدًا فَقَدْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَشْرَبُ قَاعِدًا
‘আলী রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু দাঁড়িয়ে পানি পান করলেন এবং লোকেরা যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই আলী রাদি’আল্লাহু ‘আনহুর দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টি দিলেন। তখন ‘আলী রাদি’আল্লাহু ‘আনহু বললেন তোমরা কি দেখছো? যদি আমি দাঁড়িয়ে পানি পান করি তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে দেখেছি তিনি দাঁড়িয়ে পানি পান করেছেন আর আমি যদি বসে পানি পান করি তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে বসে পানি পান করতে দেখেছি। (মুসনাদ আহমাদ ৭৯৭)
আহমাদ শাকের (রহ.) এর সনদকে সহিহ বলেছেন। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে মূলত রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে ‘আলী ইবনে আবি ত্বলিব রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহু দাঁড়িয়েও পানি পান করতে দেখেছেন এবং বসেও পানি পান করতে দেখেছেন অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ ﷺ দুই ভাবেই পানি পান করেছেন।
৫ম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ‘আব্দুল্লাহ্ ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তিনি বলেন,
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُما قَالَ : كُنَّا نَأْكُلُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ نَمْشِي ، وَنَشْرَبُ وَنَحْنُ قِيَامٌ
“রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর যুগে আমরা খাবার খেতাম এ অবস্থায় যে আমরা হাঁটছি বা চলাচল করছি অর্থাৎ হাঁটা অবস্থায় আমরা খাওয়াদাওয়া করতাম এবং আমরা দাঁড়িয়ে পান করতাম।” (সুনান তিরমিযী ১৮৮১)
শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) সহিহুল তিরমিযীর মধ্যে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
এখানে আমরা আল্লাহর রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত পাঁচটি হাদিসের কথা উল্লেখ করেছি। যেখানে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ পান করার ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আসুন এবার আমরা সমস্ত হাদিসগুলো একসাথ করি। সমস্ত হাদিসগুলোকে একসাথ করলে যেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে তা নিম্নরূপঃ
১. আল্লাহর নবী ﷺ সাধারণত দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন তাই দাঁড়িয়ে পানি পান করা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনার পরিপন্থী। এর দলিল হচ্ছে সে হাদিস যে হাদিসটি আনাস ইবনে মালিক ও আবু সাঈদ খুদরি রাদি’আল্লাহু তা’আলা ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য সমস্ত ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য অনুযায়ী বসে পান করাটাই মূলত উত্তম। আর দাঁড়িয়ে পানি পান করার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি ছিল রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর নির্দেশনামূলক, নির্দেশমূলক নয়। অর্থাৎ রাসূল ﷺ নিষেধ করেছেন বা হারাম ব্যাপারটি এমন নয়। বরং সমস্ত ‘উলামায়ে কিরাম রাসূল ﷺ এর ‘আমল এবং রাসূল ﷺ এর বক্তব্য সবগুলোকে একসাথ করে এই বক্তব্য দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এখানে যে নিষেধ করেছেন এটি নির্দেশনামূলক; নিষেধ বা হারামের জন্য নয় অথবা রাসূল ﷺ অপছন্দ করেছেন এজন্যও নয়। তাই এখানে উত্তম হচ্ছে বসে পানি পান করা; এটি সকল পানির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
২. হাদিসের আলোকে যেটি সাব্যস্ত হয়েছে আল্লাহর নবী ﷺ দাঁড়িয়ে পান করেছেন, যে বক্তব্যটি ‘আলী ইবনে আবি ত্বলিব (রা.) থেকে পাওয়া যায় এবং এ বক্তব্য আব্দুল্লাহ্ ইবনে ‘উমার (রা.) এর বর্ণনা থেকেও পাওয়া যায়। এখান থেকে বুঝা যায় লিল জাওয়ায বা জায়েয বা বৈধ বুঝানোর জন্য আল্লাহর নবী ﷺ এ কাজটি করেছেন যাতে করে কেউ মনে না করে যে দাঁড়িয়ে পানি পান করা নাজায়েয, হারাম বা অবৈধ। বরং নবী ﷺ এর ‘আমল থেকে এটি সাব্যস্ত হয়েছে।
৩. যে বিষয়টি আলোচনায় আসবে সেটি হচ্ছে জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা সুন্নাহ কিনা? জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা সুন্নাহ নয় বরং যেই হাদিসগুলোতে রাসূলুল্ললাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন বর্ণনা পাওয়া যায় এই হাদিসগুলো থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ্ ﷺ জাওয়ায বা জায়েয বুঝানোর জন্য জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন। কেননা, পানি পান করার সুন্নাহ্ এবং ‘আদব হচ্ছে বসে পানি পান করা। সেক্ষেত্রে এই সুন্নাহর অনুসরণ করাটাই হচ্ছে উত্তম। কিন্তু কেউ যদি দাঁড়িয়ে পানি পান করেন তাহলে সেটি তার জন্য জায়েয রয়েছে।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে আল্লাহর নবী ﷺ জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন কেন? সেখানে ‘উলামায়ে কিরাম কমন যেই বক্তব্যটি দিয়েছেন সেটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ লোকদেরকে এটা স্পষ্ট করে বুঝানোর জন্য যে দাঁড়িয়ে পানি পান করা হারাম বা কঠোর কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। তবে আরেকদল আহলুল হাদিস ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ জমজমের পানি দাঁড়িয়ে এজন্য পান করেছেন রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কে একটি বালতি থেকে পানি পান করেছেন। সেখানে এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যার কারণে বসে পান করা সম্ভব ছিল না। তাই রাসূলুল্লাহ্ ﷺ দাঁড়িয়ে পান করেছেন। এসব হাদিস থেকে বুঝা যায় যে আল্লাহর রাসূল ﷺ কখনো দাঁড়িয়ে পান করেছেন আবার কখনো বসে পান করেছেন। তাই সৌদি ‘আরবের ‘উলামা পরিষদ এবং ফাতাওয়ার স্থায়ী কমিটির ফাতাওয়া হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ যেখানে জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন সেখানে বিশেষ কোনো কারণ অথবা ব্যক্তিগত কারণ ছিল। তবে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর কমন নির্দেশনা হচ্ছে পানি পান করার ক্ষেত্রে বসে পানি পান করা। তাই উত্তম হচ্ছে কেউ পানি পান করলে বসে পান করবেন, সেটি জমজমের পানি হলেও।জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করতে হবে এটা সুন্নাত বা অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্যের মাধ্যমেও এটি সাব্যস্ত হয়নি। শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক ‘আলেম বলেছেন যে জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা সুন্নাত যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ ﷺ দাঁড়িয়ে পান করেছেন। সুতরাং দাঁড়িয়ে পানি পান করা সুন্নাহ্ নয় বরং জায়েয। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।