পবিত্র কুর’আন, দ্বীন ইসলামে এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় যে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, পৃথিবীর আর কোন একটি ধর্মের বেলায়, সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থকে এ ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। মুসলিম জীবনে কুর’আনের ভূমিকা কি তা অনুভব করার ব্যাপারটাও হয়তো বা সবার জন্য উন্মুক্ত নয় – অনেকে যেমন মনে করেন যে, কুর’আনের পথনির্দেশনা এবং নিরঙ্কুশ জ্ঞানের ভান্ডারও সবার জন্য উন্মুক্ত নয়, কেবল বিশ্বস্ত বিশ্বাসী বা সম্ভাব্য হেদায়েত লাভের যোগ্যতা সম্পন্ন সৌভাগ্যবানদের জন্যই তা উন্মুক্ত হয়ে থাকে। তেমনি এই ব্যাপারটাও – অর্থাৎ, কুর’আনের ভূমিকার গুরুত্ব বোঝার ব্যাপারটাও – সম্ভবত কেবল নির্বাচিত ও বিশিষ্টদের জন্য নির্ধারিত। ইহুদী বা খৃস্টধর্মাবলম্বী কুফফার ওরিয়েন্টালিস্টগণ – খৃস্টধর্মের উপর যাদের রয়েছে বিস্তর পড়াশোনা – তারা তাদের নিজেদের মত করে ব্যাপারটাকে কিছুটা আঁচ করার চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন যে, খৃস্টধর্মের বেলায় যীশুর যে গুরুত্ব – ইসলামের বেলায় কুর’আন সেই ধরনের গুরুত্বের অধিকারী। ‘যীশুকে অবতার ভাবার’ মত কুফরে নিমজ্জিত থেকেও, তারা একধরনের ব্যাখ্যা দান করার চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন যে, যীশু হচ্ছেন ঈশ্বরের Word made flesh, আর কুর’আন হচ্ছে ঈশ্বরের Word made book। খৃস্টানদের এই বক্তব্যে, কুর’আন যে আল্লাহর বাণী এই ধারণার একটা vague স্বীকৃতি রয়েছে বলে, আমাদের অনেকেই ভুলে যাই যে, উপরোক্ত বক্তব্যের প্রথমার্ধে একটা সূক্ষ্ম অথচ ভয়ঙ্কর ‘কুফরি’ রয়েছে এবং আমরা মুসলিমরাও নিজেদের অজান্তেই ঐ কুফরির ফাঁদে পা দিই। কুর’আন আল্লাহর বাণী বলে তা আল্লাহর সিফাতের একটা অংশ এবং সেহেতু divine বা ঐশ্বরিক – অর্থাৎ সৃষ্ট বস্তু নয় ; যীশুও যদি আল্লাহর বাণীর ‘রক্ত-মাংসে রূপান্তরিত অবস্থা’ বা Word made flesh হয়ে থাকেন, তবে তো তিনিও divine বা ঐশ্বরিক এবং সৃষ্ট কোন প্রাণী নন! এখানেই নিহিত রয়েছে এমন ধারণা যা ইসলামের দৃষ্টিতে নির্ভেজাল ‘কুফরি’।
রাসূল(সা.)-এঁর ভবিষ্যদ্বাণীকে ইতোমধ্যেই বাস্তবতা দান করে মুসলিম উম্মাহ্ যে আজ ৭৩ ভাগে বা তারও চেয়ে বেশী ভাগে বিভক্ত, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। অন্য অনেক কিছুর মতই – কুর’আনকে নিয়ে আমরা কি করবো – এই ব্যাপারটা নিয়েই মুসলিম উম্মাহ্ আজ শতধাবিভক্ত। ইসলামের কেন্দ্রীয় ব্যাপার – বলতে গেলে মেরুদন্ড স্বরূপ – এই কুর’আনকে নিয়ে আমাদের অজ্ঞতা ও বিভক্তি কুফফারকে সাহস ও শক্তি যোগায়। তারা বুঝতে পারে যে, আমাদের নিয়ে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। কুর’আনকে নিয়ে আমাদের মতপার্থক্য, বিভ্রান্তি ও বিভক্তির রকমফের একাধারে করুণ ও হাস্যকর। অপাঠ্য ছোট্ট অক্ষরে ছাপা কুর’আনকে একদিকে যেমন কেবল মাদুলির মত গলায় ঝুলিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়, তেমনি, কারুকাজপূর্ণ এমন বিশাল কুর’আনও রয়েছে যার শিল্পকর্ম সম্পন্ন করতে হয়তো কোন শিল্পীর গোটা জীবনটাই কেটে গেছে; আবার এমন অনেক কুর’আনিক ক্যালিগ্রাফি আছে যার পাঠোদ্ধার করা আমার মত সাধারণ মুসলিমের জন্য দুরূহ। “কুর’আন সবার জন্য নয় বরং গণমানুষ অর্থসহ কুর’আন পড়তে গেলে বিপথগামী হয়ে যাবে” – এমন কথা যেমন উপমহাদেশে দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগকারী গোষ্ঠী বিশেষ প্রচার করে থাকেন। আবার, “যে কেউ একখানা কুর’আন হাতে নিয়ে অর্থসমেত পড়তে শুরু করলেই, সব সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন” – এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে – যার মর্মার্থ অনেকটা এরকম যে, একখানা Gray’s Anatomy হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেই, যে কেউ নিজের চিকিৎসা নিজেই করতে পারবেন। কত স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষকে দেখা যায় একটি বর্ণের অর্থ না বুঝেও জীবনের প্রতিটি দিন সকাল বিকাল কুর’আন তেলাওয়াতের (প্রচলিত অর্থে) আমল করে কবরে চলে যান – আবার, কত অভাগা মানুষকে দেখা যায় কুর’আনের ভাষা জানা ও বোঝা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কুর’আনের কোন ছাপ নেই। আরো বেশি অভাগা আরেকটা শ্রেণীকে দেখা যায়, পশ্চিম থেকে ধার করা scientific reductionism-এর আলোকে কুর’আনকে ব্যাখ্যা করতে চেয়ে, পথভ্রষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত “কাফির হয়ে যাবার” পরিণতি বরণ করতে (যেমনটা ঘটেছিল ড. রাশাদ খলিফার বেলায়, যিনি ১৯ সংখ্যা ভিত্তিক ফর্মূলায় পবিত্র কুর’আনকে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন)। এটা তো সত্যি যে, কুর’আনের কাছে যাবার সঠিক ও শুদ্ধ পন্থা কি তা না বুঝলেও এবং না জানলেও, আমরা যে কুর’আন থেকে উপকৃত হতে পারছি না – কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন সকল মুসলিমই একথা জানেন। কুর’আন তার অনুসারীদের যে সাফল্য, যে সম্মান, যে আসন, যে শান্তি ও যে অর্জনের অঙ্গীকার করে – বিশ্বব্যাপী কুফফারের লাথি খেয়ে, তাদের পা থেকে পায়ে ঘুরে বেড়ানো মুসলিম জনসমষ্টিসমূহকে দেখে কোথাও তার কোন চিহ্ন খুজে পাওয়া দুষ্কর। বরং, স্বাভাবিক ভাবেই যে কারো মনে হতে পারে যে, কোথাও মারাত্মক কোন গোলমাল বা সমস্যা রয়েছে – এবং নিম্ন মানের ঈমান সম্পন্ন কারো, গভীর নিরাশা উদ্ভূত কুফরিতে ডুবে যাবার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা আল্লাহর কাছে শয়তানের চিরন্তন অবস্থা: আল্লাহর দয়ায় নিরাশ হওয়া থেকে আশ্রয় চাই এবং সেই নৈরাশ্যের আনুষঙ্গিক কুফরি থেকেও আশ্রয় চাই। আমীন!!
অথচ কই, যাদের জন্য ও যাদের কাছে এই কুর’আন নাযিল হয়েছে, তাদের মাঝে তো কুর’আন শ্রবণকালে সেই বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ বা সমীহভাব জেগে ওঠে না! ইমাম আনোয়ার আল আওলাকি তাঁর এক খুৎবায় বলেন যে, ইসরাইলী রাষ্ট্রীয় রেডিও থেকে নাকি আরবদের জন্য কুর’আন তিলাওয়াত (প্রচলিত অর্থে) সম্প্রচার করা হয়, কারণ ইহুদীরা জানে যে, উদ্দিষ্ট আরবরা কুর’আন বুঝে না বিধায় তাদের উপর কুর’আন কোন প্রভাব বিস্তার করবে না – আর তাই তা সম্প্রচার করা একেবারেই নিরাপদ। আমাদের দেশের অবস্থা আরও করুণ!! আপনি দেখবেন কোন বাজারে দিনের শুরুতে দোকানদার, বারাক্বার (অর্থাৎ বরকতের) জন্য পবিত্র কুর’আনের তিলাওয়াতের একটা ক্যাসেট ছেড়ে দিয়ে অনায়াসে বিকিকিনি চালিয়ে যাচ্ছে – এমনকি ভিডিও সিডির দোকানেও। কিছুদিন আগে দৌলতদিয়া ঘাটের বেশ্যা পুনর্বাসন আন্দোলনের সভা নাকি শুরু হয়েছিল যথারীতি কুর’আন তিলাওয়াত দিয়ে।
এই পর্যায়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে share করতে চাই। এই তো কিছুদিন আগে সিলেটে আমার দেশের বাড়ীতে যাবার সময় আমরা সদ্য চালু হওয়া বহুল প্রশংসিত আধুনিক এক কোম্পানীর বাসে চড়েছিলাম – আত্মীয় স্বজনের মুখে আরমদায়ক ও স্বল্পদৈর্ঘ্য যাত্রার অনেক সুনাম শুনে ঐ বাসে যাওয়া। যাত্রা শুরু হলো সূরা ইয়াসীনের বাংলা তর্জমা সহকারে তিলাওয়াত দিয়ে। একসময় তিলাওয়াত শেষে টিভি সেটে হিন্দি গান ইত্যাদির ভিডিও শুরু হলো। অনেকদিন ধরে আমার ঘরে টিভি চলেনা বলে এবং বিনোদন জগতের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই বলে আমি প্রায় ভুলেই বসেছিলাম যে, “আ মরি বাংলা ভাষা” বলে মায়াকান্না কাঁদা বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের কাছে হিন্দি ও হিন্দু সংস্কৃতির উপাদান, প্রায় শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের মতই অত্যাবশ্যক – যা বিহনে সাড়ে ৪ ঘন্টার ঐ ‘বি-শা-ল’ (!!)সময় অতিক্রান্ত হওয়া বুঝি এক অকল্পনীয় একটা ব্যাপার !!! তাই বুঝি অধীর আগ্রহে অনেকে অপেক্ষা করে ছিলেন যে, কখন ঐ অর্থহীন ও বৈচিত্রহীন একঘেঁয়ে বাক্যালাপ শেষ হয়। গান বাজনা শুরু হতে বাসে যেন প্রাণের স্পন্দন ফিরে এলো – এমনকি হিজাব পরতে সচেষ্ট এক মা, তার বয়ঃসন্ধিতে উপনীত পুত্রের সাথে চটকদার অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে আলাপ করতে করতে হাসতে হাসতে যে ভাবে ওগুলো গিললেন, তাতে বোঝা গেলো বাড়ীতেও তারা ‘সপরিবারে’ ওসব উপভোগ করে থাকেন। ঐ একই পরিবারের সাফারী স্যুট পরা (সুন্দর ভাবে ছাঁটা) দাড়ি ওয়ালা আধুনিক ইসলামপন্থী সদৃশ বাবা, সামনের সারিতে একেবারে ঝুলন্ত টিভি সেটটির নীচেই বসেছিলেন তার আত্মজাকে নিয়ে – তার মুখেও কোন অস্বস্তির চিহ্ন দেখেছি বলে মনে করতে পারিনা। সমাজতন্ত্রী কুফরপন্থীরা যে ইসলামপন্থীদের প্রতিক্রিয়াশীল বলে গাল দেয় – সেই অপবাদ বুঝি এতদিনে ঘুচ্লো। আমার সিলেট ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়ে রইলো এমন কিছু রিমেক হিন্দি গানের দৃশ্য, যা দেখে আমি বুঝলাম যে, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে – নাস্তিক ও কাফিরদের নেতৃত্বাধীন পৃথিবীর সর্ব সাম্প্রতিক যৌন বিকৃতি pedophilia-র উপাদান, আমাদের এই “উদারপন্থী মুসলিম দেশের” মুসলিম ভাই-বোনদের মগজে ইতোমধ্যেই চাঞ্চল্যকর আবেদনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে – ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!!
মধ্যবয়সে উপনীত হয়ে পবিত্র কুর’আন যখন প্রথমবারের মত অর্থসহ পড়ে শেষ করলাম, তখন এই ভেবে পুলকিত বোধ করেছিলাম যে, একটা অনস্বীকার্য কর্তব্য বুঝি দেরীতে হলেও এতদিনে সমাধা করা গেলো। পরে যখন কোন বিশ্বমাপের ‘আলেমের বর্ণনায় কোন একটা আয়াতের ব্যাখ্যা শুনে মনে হয়েছে যে, ঐ ধরনের বক্তব্য এই প্রথমবারের মত শুনলাম – তখন বুঝলাম যে অর্থসহ কুর’আন পড়া, আর কুর’আনের অর্থ অনুধাবন করা এক ব্যাপার নয়। কিন্তু আমরা যারা দ্বীন শিক্ষায় শিক্ষিত নই, অথচ যে কোন ‘হুজুরের’ উপর যারা আস্থা রাখতে পারিনা, তারা তাহলে কোথায় যাবো? এছাড়া আমরা যারা নিজ চেষ্টায় বহু কষ্টে ইসলাম শিখার ও জানার চেষ্টা করছি, তারা যখন কোন আত্মীয় বা সুহৃদকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে কোন একটা খারাপ বা পরিত্যাজ্য বিষয় থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে কোন আদেশ বা নিষেধ করছি – তখন সেই আত্মীয় বা সুহৃদ অনায়াসে জাতীয় পর্যায়ের এমন একজন ‘আলেম পেয়ে যাচ্ছেন, যিনি তার সকল কর্মকান্ডকে জায়েজ করে দিয়ে, তার মনের অপরাধবোধ নিমেষেই দূর করে দিচ্ছেন। এভাবেই তাহলে দৌলতদিয়া ঘাটের বেশ্যাদের আন্দোলনের সভায় কুর’আন তিলাওয়াত ও দোয়া করার জন্য ‘হুজুর’ পাওয়া যাচ্ছে, আর এভাবেই তাহলে আত্মস্বীকৃত কাফির হুমায়ুন আজাদের জানাজা পড়ানোর জন্যও লোকের অভাব হয়নি আমাদের এই ‘উদারপন্থী মুসলিম দেশে’ – এভাবেই তাহলে চিত্র-নায়ক ও চিত্র-নায়িকাদের সমন্বয়ে চিত্রায়িত ‘ইসলামী নাটক’কে জায়েজ মনে করেছেন এক শ্রেণীর ‘আলেমরা। আর এভাবেই তাহলে Indian idol বা হিন্দুস্থানী মূর্তির পূজার আয়োজনে “নীরবতা সম্মতির লক্ষণ” – এই সূত্র অনুযায়ী, সায় দিয়েছিলেন, বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া বিজ্ঞ ইসলাম বিশারদরা।
এরকম একটা সংশয়ের ভিতর, বোধশক্তির যখন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটা অবস্থা – তখন আমি ধর্মান্তরিত মুসলিম, ভাই Jamaal al-Din M. Zarabozo-র লেখা How to Approach and Understand the Quran বইখানি পড়তে শুরু করি। এসময় আমি আরো জানি যে: এক সময় ওমর (রা.) ভাবছিলেন যে একই নবী এবং একই কিবলা থাকা সত্ত্বেও কেন মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হবে। তিনি ইবনে আব্বাসের (রা.) কাছে লোক পাঠালেন এবং এ সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, “হে আমীরুল মু’মিনীন, আমাদের মাঝে কুর’আন নাযিল হয়েছিল ও আমরা তা আবৃত্তি করি এবং আমরা জানি যে, কি নাযিল হয়েছিল। আমাদের পরে এমন মানুষজন আসবে, যারা কুর’আন আবৃত্তি করবে, কিন্তু যারা জানবে না যে কোন পটভূমিতে তা নাযিল হয়েছিল। সুতরাং তারা তাদের মতামত ব্যবহার করবে (কুর’আন ব্যাখ্যার ব্যাপারে)। আর তারা যখন তাদের মতামতের শরণাপন্ন হবে, তখনই তারা মতপার্থক্য পোষণ করবে এবং একে অপরের সাথে যুদ্ধ করবে।”
আজ বুঝি আমরা সেই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি – যখন সবাই সবার মতবাদ ব্যাখ্যা করতে বা নিজ মতামতকে যথাযথ প্রমাণ করতে, নিজ মনগড়া উপায়ে কুর’আনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
কুর’আনের কাছে যাবার, কুর’আনের ভাষা ও বক্তব্য বুঝবার, কুর’আনের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবার এবং কুর’আনের কাছ থেকে উপকৃত হবার সঠিক পন্থাসমূহ কি কি – সে সম্বন্ধে অমূল্য তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ এই বইখানি পড়া থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান, বাংলাভাষী দ্বীনী ভাই-বোনদের সাথে ভাগাভাগি করার অদম্য ইচ্ছা থেকেই মূলত এই কাজে হাত দেয়া।
[মূল লেখা: Jamaal al-Din M. Zarabozo-র]
“হে আহলে কিতাব! তোমাদের কাছে আমাদের রাসূল এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা কিছু লুকিয়ে রাখতে তা প্রকাশ করতে এবং যা কিছু অপ্রয়োজনীয় তা বাদ দিতে। আল্লাহর কাছ থেকে তোমাদের কাছে এক (নতুন) আলো এবং হেদায়েত দানকারী গ্রন্থ এসেছে। যা দিয়ে আল্লাহ্ তাদের সকলকে পথ নিদের্শনা দেন, যারা শান্তি ও নিরাপত্তার পথে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তাদের, তাঁর ইচ্ছামত অন্ধকার থেকে সেই আলোতে বের করে নিয়ে এসে সেই পথে পরিচালিত করেন – যা সরল।” (সূরা মায়িদা, ৫:১৫-১৬)
الر كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
“আলিফ-লাম-রা, একখানি কিতাব, যা আমরা তোমার কাছে নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে নিয়ে আসতে পারো – তাঁর পথে যিনি পরাক্রমশালী, সকল প্রশংসার দাবীদার।” (সূরা ইব্রাহিম, ১৪:১)
কুর’আনের এই বাণীগুলো পড়ে যখন কোন অবিশ্বাসী কাফির বা সন্দেহবাদী আজকের পৃথিবীর মুসলিমদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখবে, তখন সে প্রশ্ন করতে পারে :কুর’আনের এই কথাগুলো কি বাস্তবিকই সত্যি? যারা কুর’আনের এই কথাগুলোকে বিশ্বাস করে বলে ও জীবনে প্রয়োগ করে বলে দাবী করে, তাদের জীবনে এসবের প্রভাব ও প্রতিফলন কোথায়? কেউ কি মুসলিমদের সত্যি আলোর জগতে বসবাস করতে দেখে, নাকি স্বভাবতই তাদের এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা বলে মনে হয়?
স্পষ্টতই, কুর’আনে লিপিবদ্ধ আল্লাহর এই কথাগুলো সত্য। এ কথাগুলোর ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আসলে কেউ যখন কুর’আনের ইতিহাস পড়ে দেখবেন এবং অতীতে যারা কুর’আন বিশ্বাস করেছিলেন, তাদের উপর কুর’আনের কি প্রভাব পড়েছিল সে সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করবেন – তখন যে কেউ অনুধাবন করবেন যে, কুর’আনের উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত কথাগুলো তাঁদের জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এক বাস্তবতা যে, মুসলিমরা দিকনির্দেশনা সম্বলিত এই মহান কিতাবখানির অধিকারী হলেও, বর্তমানে তাদের জীবনে এর শিক্ষার আশীর্বাদ বা দিকনির্দেশনার কোন প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতা কারো কারো কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে। মুসলিমরা বর্তমানে যে অবস্থায় পতিত হয়েছে – কি করে সেই পরিণতিতে তারা পৌঁছতে পারে – কারো জন্য তা অনুধাবন করা কষ্টকর হতে পারে। মুসলিমরা কিভাবে কুর’আনকে গ্রহণ করছে এবং আত্মস্থ করছে – এর মাঝেই সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। সম্ভবত, কুর’আনের প্রতি তাদের আচরণে কোথাও কোন সমস্যা রয়েছে। এ থেকে এমন একটা অবস্থার উদ্ভব হয় যে, কোন একটা বিষয়ে কুর’আনে দিকনির্দেশনা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানবতার উপর তার যে প্রভাব প্রতিফলিত হবার কথা ছিল – তা হচ্ছে না।
আমাদের এই প্রচেষ্টায় আমরা তাই, আজকের দিনের অনেক মুসলিম কুর’আনের সাথে কি ধরনের আচরণ করছেন – সেদিকে আলোকপাত করব। তারপর আমরা চেষ্টা করবো, সঠিক আচরণটা কি – তা ভেবে দেখতে। সবশেষে পবিত্র কুর’আনকে সঠিক ভাবে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার পন্থা কি হতে পারে, তা নিয়েও আমরা আলোচনা করব ইনশা’আল্লাহ্!
কুর’আন তার অনুসারীদের জন্য কি ধরনের জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং বাস্তবে আজকের মুসলিমদের জীবনযাত্রার শোচনীয় অবস্থার মাঝে যে দুস্তর ব্যবধান, তার কারণসমূহ বুঝবার এই প্রচেষ্টায় আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করবো ইনশা’আল্লাহ্:
১. আলোচ্য বিষয়াবলী
২. কুর’আনের বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রতি আমাদের কর্তব্য
৩. কুর’আনিক প্রজন্ম
৪. কুর’আনের প্রতি সমকালীন মুসলিমদের আচরণ
৫. কুর’আনের মুখ্য উদ্দেশ্য
৬. কুর’আনের নিকটবর্তী হবার পন্থা ও করণীয়
৭. কুর’আন ব্যাখ্যার (তাফসীরের) সঠিক পন্থা
৮. কুর’আনের কাছে প্রত্যাবর্তনের আবশ্যকতা
৯. উপসংহার বা শেষ কথা।
আমরা আশা করছি যে, আমাদের এই প্রচেষ্টায় সংযোজিত বা আলোচিত বিষয়াবলী বিচার-বিশ্লেষণের পরে, কুর’আন বোঝার ব্যাপারে আমাদের দুর্বলতা ও দীনতা অনেকাংশেই দূর হবে ইনশা’আল্লাহ্। আমাদের এই প্রচেষ্টার মূলে রয়েছে এই অপূর্ব সুন্দর ও অলৌকিক কুর’আন থেকে বাংলাভাষী মুসলিমরা যাতে যথাসম্ভব বেশি উপকৃত হতে পারেন, সে ব্যাপারে তাদের সহায়তা করা। যেভাবে কুর’আনের নিকটবর্তী হওয়া উচিত, সেভাবে কুর’আনের কাছে যেতে পারলেই তাদের উপর কুর’আনের সেই কাঙ্খিত প্রভাব অনুভূত ও প্রতিফলিত হবে। তখন, কুর’আন মুসলিমদের আল্লাহর আরো কাছাকাছি নিয়ে যাবে, এবং ইসলাম সম্বন্ধে তাদের জ্ঞানকে আরো পরিপূর্ণ করে দেবে। তারা তখন এই পৃথিবীতে তাদের সত্যিকার ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারবেন। সবশেষে আমরা আশা করবো, কুর’আনের সঠিক জ্ঞান আখিরাতে তাদের জান্নাতের পথে নিয়ে যাবে – কুর’আনের সঠিক জ্ঞান ও প্রয়োগ আখিরাতে তাদের পক্ষে এক প্রমাণ ও মধ্যস্থতাকারী স্বরূপ কাজ করবে – আর আল্লাহ্ তাদের উপর সন্তুষ্ট থাকবেন, ইনশা’আল্লাহ্!।
কোন মুসলিমই সম্ভবত কখনো এই সত্যটা ভুলে যান না যে, কুর’আন হচ্ছে সরাসরি আল্লাহর বাণী যা তিনি তাঁর শেষ রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এঁর কাছে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, একজন মুসলিম এই সত্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পূর্ণরূপে নাও বুঝতে পারেন। কুর’আনে আল্লাহ্ যেসব চমৎকার বিষয়াবলী বর্ণনা করেছেন, তার কিয়দংশ তিনি ভুলে থাকতে পারেন – অথবা রাসূল (সা.) কুর’আন সম্বন্ধে যা বলেছেন, সে ব্যাপারটাকেও হয়তো তিনি অবহেলা করে থাকতে পারেন। এই অধ্যায়ে তাই আমরা প্রথমে চেষ্টা করবো কুর’আন আসলে কি, তা পাঠককে মনে করিয়ে দিতে। নিঃসন্দেহে একজন বিশ্বাসী কুর’আন সম্বন্ধে যত জানবেন – কুর’আনের কাছ থেকে তিনি তত বেশি নিতে চাইবেন। কোন ব্যক্তি কুর’আনকে যত বেশি উপলব্ধি করবেন, তত বেশি তিনি সেটাকে তার হৃদয় ও মনের কাছাকাছি রাখতে চাইবেন। অবশ্যই যিনি কুর’আনকে সবচেয়ে ভাল জানেন, তিনি হচ্ছেন এর বক্তা – স্বয়ং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। তাই প্রথমে আমরা কুর’আনের কিছু নির্বাচিত আয়াত আলোচনা করবো, যেসব আয়াতে কুর’আন নিজের সম্বন্ধে কথা বলে। কুর’আনের উপলব্ধিতে যাঁর স্থান দ্বিতীয়, তিনি হচ্ছেন নবী মুহাম্মাদ (সা.), যাঁর কাছে এই কুর’আনের বাণী প্রেরণ করা হয়েছিল। আমরা তাই কুর’আন সম্পর্কে তাঁর কিছু নির্বাচিত বাণী আলোচনা করবো। এরপর আসছে ঐ সব মহান ব্যক্তিদের কথা, যাঁরা আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছ থেকে সরাসরি কুর’আন শিখেছিলেন এবং জীবনে তা প্রয়োগ করেছিলেন। আমরা কুর’আনের ব্যাপারে সাহাবীদের বক্তব্য তাই উপস্থাপন করব। এই বষিয়ে আলোচনার শেষের দিকে এই মহান গ্রন্থের প্রতি একজন মুসলিমের কর্তব্য কি – আমরা তা নিয়ে এক সাধারণ আলোচনা করব, ইনশা’আল্লাহ্!
গতানুগতিক অনুবাদে কারো মনে হতে পারে যে, এই আয়াতে কুর’আন সম্বন্ধে এমন বিশেষ কিছু বলা হয়নি। যদিও বাস্তবে আল্লাহ্ এই একটি আয়াতে কুর’আন সম্বন্ধে অনেক কয়টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এই বর্ণনায় লক্ষ্য করার মত প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ কুর’আনকে ‘নির্দেশক সর্বনাম’ ذَلِكَ সহকারে নির্দেশ করেছেন – সাধারণভাবে যার অনুবাদ হবে ‘ঐটা’ (কিন্তু ‘এটা’ নয়)। এখানে ‘এটা’র পরিবর্তে ‘ঐটা’ ব্যবহার করার কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আবদুল হামিদ সিদ্দিকী তাঁর কুর’আনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় এ সম্বন্ধে বলেছেন :“নির্দেশক সর্বনাম’ ذَلِكَ (that) অবস্থানের দূরত্ব নির্দেশ করে, কিন্তু সময় বিশেষে কোন বস্তুর প্রতি সম্মান ও সম্ভ্রম/সমীহ প্রদর্শন করতেও এর ব্যবহার হয়ে থাকে, যেমনটি আমরা কুর’আনে হতে দেখি।”
এই আয়াত তাই আমাদের বলে দিচ্ছে যে, কুর’আন হচ্ছে সর্বোপরি পথ-নির্দেশনার একখানি গ্রন্থ। সবশেষে এই আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন, যারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে সচেতন, তাদের জন্য কিতাবখানি হচ্ছে পথ-নির্দেশনা। কুর’আনের অন্যত্র আল্লাহ্ বলেছেন :
هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ
“…মানবজাতির জন্য এক পথ-নির্দেশনা ও যাচাইয়ের (সত্য-মিথ্যা) জন্য এক স্পষ্ট প্রমাণ…” (সূরা বাক্বারা, ২:১৮৫)
কুর’আনের এই দুইটি আয়াত (২:২, ২:১৮৫) আমাদের বলে দিচ্ছে যে, কুর’আনের দিক-নির্দেশনা ও তা থেকে লাভবান হবার সম্ভাবনা সবার জন্য উন্মুক্ত। অথচ, সবাই এই চমৎকার দিক নির্দেশনা থেকে লাভবান হবে না। কেবল মাত্র তারা, যারা সঠিক পন্থা অবলম্বন করে কুর’আনকে মেনে চলার ও জীবনে প্রয়োগ করার ইচ্ছা নিয়ে এর নিকটবর্তী হবে, তারাই এ থেকে সত্যিকার অর্থে লাভবান হবে।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ৬
আল্লাহ্ কুর’আন সম্বন্ধে কি বলেন
কুর’আন সম্বন্ধে আল্লাহ্ আরো বলেন :
“(হে মানবকুল) অবশ্যই আমরা তোমাদের জন্য একটি কিতাব নাযিল করেছি যাতে তোমাদের জন্য রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা (যারা তা অনুসরণ করবে তাদের জন্য)। তোমরা কি তাহলে তা বুঝবে না?” (সূরা আম্বিয়া, ২১:১০)
এই আয়াত প্রথমে কুরাইশী আরবদের উদ্দেশ্যে ছিল, যদিও এর মর্মার্থ সাধারণভাবে সকল বিশ্বাসী বা সকল মানুষের বেলায় প্রযোজ্য [রাসূল (সা.) এর সময়ের পর থেকে]। এটা আরবদের জন্য এক বিরাট আশীর্বাদ ছিল যে, কুর’আন তাদের ভাষায় নাযিল হয়েছিল। তারপর তাদের মধ্য থেকে যারা এর সাথে লেগে থাকবে, তাদের সেই সম্মান ও মর্যাদা সহকারে স্মরণ করা হবে যা আল্লাহ্ তাদের দান করেছেন। তাছাড়াও অবশ্য সকল বিশ্বাসী ও সকল মানবকুলকে এই আয়াত একথাই জানান দিচ্ছে যে, কারো মান-মর্যাদা ও বিজয় আসলে সত্যিকার বিশ্বাসীতে পরিণত হয়ে এই কুর’আনকে আঁকড়ে ধরা এবং জীবনে সেটাকে প্রয়োগ করার মাঝেই নিহিত। আল্লাহ্ বলেন :
“..সম্মান হচ্ছে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের এবং বিশ্বাসীদের ; যদিও মুনাফিকরা তা জানে না।” (সূরা মুনাফিকুন, ৬৩:৮)
এই বাস্তবতা আরবদের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। কুর’আনকে অনুসরণ করার পূর্বে তারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত ছিল না অথবা পৃথিবীর সম্মানিত কোন জাতিও ছিল না। পৃথিবীকে দেওয়ার মত তাদের এমন কিছু ছিল না। কিন্তু কুর’আন লাভ করার পর তারা পৃথিবীর কাছে তা পৌঁছে দিয়েছে। সৈয়দ কুতুব যেমন বলেছেন: কুর’আনের বাণী ছিল পৃথিবীকে উপহার দেওয়ার মত তাদের একমাত্র ঐশ্বর্য। এ দ্বারা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা পূর্ব ও পশ্চিমব্যাপী নেতৃত্বের আসনে উন্নীত হয়।
সূরা আম্বিয়ার “একটি কিতাব…যাতে তোমাদের জন্য রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা” এই অংশের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আল সাদী লিখেছেন :
“পরবর্তীতে যা সংঘটিত হয়েছে তা এই আয়াতেরই বাস্তবায়ন। সাহাবাগণ ও তার পরবর্তী প্রজন্মসমূহের যাঁরা রাসূল (দঃ)-এঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং কুর’আন থেকে যাঁরা দিক নির্দেশনা নিয়েছিলেন – তাঁরা খ্যাতি, সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং বিভিন্ন রাজসভায় সম্মানিত হয়েছিলেন – এটা সর্বজনবিদিত। একইভাবে যারা কুর’আন নিয়ে ভাবেনি এবং তা দ্বারা পরিচালিত হয়নি বা পরিশুদ্ধ হয়নি, তাদের পরিণতিও সবার জানা আছে। তারা অসম্মান, তাচ্ছিল্য ও অসুখী জীবন যাপন করেছিল। দুনিয়া এবং আখিরাতের শান্তি অর্জন করতে এই কিতাবখানি অনুসরণ করার কোন বিকল্প নেই।”
সুখ-শান্তি ও সম্মান লাভের এই নীতিমালা সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। আজো একজন বিশ্বাসী যদি সম্মানিত হতে চায়, অসম্মানজনক ও লজ্জাকর জীবন যাপন না করে যদি সম্মান ও মর্যাদা সহকারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, তবে তাকে কি করতে হবে, আল্লাহ্ তা বলে দিয়েছেন: তাদের কুর’আনের কাছে ফিরে আসতে হবে। তারা যদি কুর’আনের কাছে প্রত্যাবর্তন করে, তবে তা যে তাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সম্মান ও মর্যাদার উৎস হবে তাই নয়, বরং পরকালের চিরস্থায়ী জীবনেও তা তাদের সম্মান ও মর্যাদার উৎস হিসাবে কাজ করবে। ইসলাম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, “আমরা ছিলাম সবচেয়ে ঘৃণিত এক জনগোষ্ঠী। আল্লাহ্ আমাদের সম্মান দেখালেন এবং ইসলামের মাধ্যমে ক্ষমতা দিলেন। আমরা যদি কখনো, আল্লাহ্ আমাদের যা দিয়ে সম্মানিত করেছেন, তা ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মানিত হতে চাই, তাহলে আল্লাহ্ তখন আমাদের লাঞ্ছিত করবেন।” (আল হাকিম)। ইসলামের মতই উপরোক্ত উদ্ধৃতি কুর’আনের বেলায়ও প্রযোজ্য।
আর রাসূল (সা.) কুর’আন সম্বন্ধে বলেছেন :
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কিছু জনগোষ্ঠীকে কুর’আন দ্বারা সম্মানিত করেন আর কিছু জনগোষ্ঠীকে তা দ্বারা অধঃপতিত করেন।” (সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ)
আমরা এখানে যে অল্পকয়টি আয়াত আলোচনা করেছি, তা থেকে যে কেউ কুর’আনের গুরুত্বের একটা ধারণা লাভ করবেন। এটা এমন একটি কিতাব, যাতে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা রয়েছে – একজন মানুষের জন্য এটা হচ্ছে রূহ্ – এটা হচ্ছে এমন এক আলো যা মানুষকে পথ দেখায় – আর সকল মুসলিমের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সম্মান, মর্যাদা ও সুখ শান্তির সার্বিক উৎস হচ্ছে এই কুর’আন।
এ ছাড়া আল ফুরক্বান (ভুল ও শুদ্ধের পার্থক্যকারী), আল যিকর (স্মরণিকা), আল বুরহান (নিশ্চিত প্রমাণ) এমন বহু ভিন্ন ভিন্ন নামে আল্লাহ্ কুর’আনকে সম্বোধন করেছেন।
কুর’আনে এমন অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলো এর গুণাগুণ ও বিশেষত্ব সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান দান করে। আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এ সম্বন্ধে আমরা কুর’আন থেকে আর মাত্র দুটো উদ্ধৃতি উপস্থাপন করবো। এগুলোতে কুর’আনের বক্তা ও নাযিলকারী – যিনি একমাত্র সত্যিকার ভাবে কুর’আনকে জানেন, তিনিই কুর’আনকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যাতে এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তাকারী কারো কাছে তা অভাবনীয় মনে না হয়ে পারে না। আল্লাহ্ বলেন :
“আমরা যদি এই কুর’আনকে কোন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তবে নিশ্চয়ই তুমি দেখতে যে, ওটা আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করি মানুষের জন্য, যাতে তারা চিন্তা করে।” (সূরা হাশর, ৫৯:২৯)
আল্লাহ্ আরো বলেন :
“যদি কোন কুর’আন এমন হতো যদ্বারা পর্বতকে গতিশীল করা যেতো অথবা পৃথিবীকে বিদীর্ণ করা যেতো অথবা মৃতকে কথা বলানো যেতো [এটিই হতো সেই কুর’আন], কিন্তু সমস্ত বিষয়ই আল্লাহর আদেশের অধীন।….” (সূরা রা’দ, ১৩:৩১)
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ৭
কুর’আন সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহর (সা.) বক্তব্য
রাসূল (সা.) – যাঁর কাছে কুর’আনের বাণী সরাসরি নাযিল হয় এবং যিনি সেই অনুযায়ী তাঁর জীবন যাপন করে গেছেন – তিনিও আমাদের কুর’আনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলে গেছেন। নীচে, আমরা তাই তাঁর সেসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টি-খুলে-দেয়া বক্তব্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ আপনাদের/পাঠকের অবগতির জন্য তুলে দিচ্ছি।
রাসূল (সা.) এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে গেছেন যে, এই কুর’আন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট আশীর্বাদ ও অলৌকিক নিদর্শন। নিম্নলিখিত হাদীসে, রাসূল (সা.) পূর্ববর্তী নবীদের আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া অলৌকিক নিদর্শনসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন। অন্যান্য নবীদের দ্বারা প্রদর্শিত অলৌকিক ব্যাপারসমূহ যদিও নিঃসন্দেহে মর্যাদাপূর্ণ ছিল, তবুও সেগুলোর সঙ্গে রাসূল (সা.)-এঁর সাথে সর্বদা বিরাজমান এই অলৌকিক নিদর্শনের কোন তুলনা হতে পারে না – এমনকি মূসা (আ.)-কে যে লাঠি দেয়া হয়েছিল – অথবা ঈসা (আ.)-কে মৃতকে জীবিত করার বা অন্ধকে দৃষ্টিদানের যে অলৌকিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল – সেগুলোকেও, কুর’আনের আঙ্গিকে নবী মুহাম্মাদ (সা.) যা লাভ করেছেন, তার সাথে তুলনা করা যায় না। আর এ জন্যই কিয়ামতের দিন, নবীদের মাঝে তাঁর নিজের অনুসারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে, এ ধরনের আশা করার পেছনে রাসূল (সা.)-এঁর যথাযথ কারণ ছিল। রাসূল (সা) বলেন :
“নবীদের মাঝে এমন কেউ ছিলেন না যাঁকে এমন কিছু না দেয়া হয়েছে, যা দেখে লোকে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে। কিন্তু আমাকে কেবল এক ওহী দান করা হয়েছে, যা আল্লাহ্ আমার কাছে প্রেরণ করেছেন। তাই আমি আশা করি পুনরুত্থান দিবসে অন্য নবীদের চেয়ে আমার অনুসারীদের সংখ্যা বেশি হবে।” (বুখারী)
আল-কুর’আন অর্থাৎ আল্লাহর কথা ও বাণীর এই সংকলনের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে খানিকটা আলোকপাত করে, আরেকটি হাদীস রয়েছে যেখানে রাসূল (সা.) বলেন :
“সকল বাণীর উপর আল্লাহর বাণীর শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তাঁর সৃষ্টির উপর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের মতই ।”
(আত-তিরমিযী, আদ-দারিমী)
কেউ যখন এরকম করে কুর’আনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারবে, তখন সে নিশ্চয়ই তার সময়কে এই বাণী পড়ার কাজে নিয়োগ করতে পারবে। এবং একে অবজ্ঞা করতে পারবে না অথবা, দিক নির্দেশনার জন্য অন্য কোন উৎসের দিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন হবে না তার । রাসূল (সা.) কুর’আন সম্বন্ধে আরো বলেছেন :
“তোমাদের জন্য সুসংবাদ! নিশ্চয়ই এই কুর’আনের এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে রয়েছে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে। এর সাথে লেগে থাক, তাহলে তোমরা কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে না এবং তার পরে তোমরা কখনো বিপথগামীও হবে না।” (আত-তাবারানী – আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ)
অপর একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন :
“হে লোকসকল, নিশ্চিতই আমি কেবলি একজন মানুষ এবং অচিরেই আমার প্রভুর কাছ থেকে একজন বার্তাবাহক আমার কাছে আসতে পারেন এবং আমি তার ডাকে সাড়া দেব (অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করবো)। আমি তোমাদের জন্য দুটি গুরুভার বস্তু রেখে যাচ্ছি। প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। যার মাঝে রয়েছে দিক নির্দেশনা ও আলো। যে এর সাথে লেগে থাকবে এবং এর অনুসরণ করবে সে সঠিক পথের উপর থাকবে। যে এর সাথে লেগে থাকতে ব্যর্থ হবে সে বিপথগামী হবে। সুতরাং আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ কর এবং এর সাথে লেগে থাক। …” (আহমাদ)
আরেকটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন :
“ ‘নিশ্চিত এই মানবজাতির মাঝে, আল্লাহর বিশেষ জনগোষ্ঠী রয়েছে।’ তারা জিজ্ঞেস করলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, তারা কারা?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘তারা হচ্ছে কুর’আনের জনগোষ্ঠী। তারা হচ্ছে আল্লাহর জনগোষ্ঠী এবং বিশেষভাবে তাঁর।’ ” (আহমাদ, ইবনে মাজা, নাসাঈ – আলবানীর মতে সহীহ)
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন :
“তোমাদের মাঝে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ যে কুর’আন শিখে ও অন্যদের শিক্ষা দেয়।” (বুখারী)
কুর’আন সম্বন্ধে তিনি আরো বলেছেন :
“জ্ঞান আহরণের জন্য যে কেউ যখন কোন পথ অনুসরণ করবে, আল্লাহ্ সেজন্য, তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেবেন। এমন কোন জনসমষ্টি নেই, যারা আল্লাহর ঘরগুলির কোন একটিতে সমবেত হয়ে নিজেদের মাঝে কুর’আন পাঠ করে ও অধ্যয়ন করে, অথচ তাদের উপর প্রশান্তি নেমে আসে না, রহমত নেমে আসে না, ফেরেশতারা তাদের পাশে আসে না এবং আল্লাহ্, তাঁর কাছে উপস্থিতদের কাছে তাদের নাম উল্লেখ করেন না। কর্মফলের বিচারে যে পিছিয়ে পড়বে, বংশপরিচয়ের উৎকৃষ্টতা তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।” (মুসলিম)
আরেকটি বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন :
“কুর’আন তিলাওয়াতকারী মুমিনের উদাহরণ হচ্ছে সেই লেবুর মত যা স্বাদে ও গন্ধে উত্তম এবং সে, যে কুর’আন তিলাওয়াত করে না তার অবস্থা হচ্ছে ঐ খেজুরের মত যা স্বাদে উত্তম কিন্তু যার কোন গন্ধ নেই এবং যে মুনাফিক কুর’আন তিলাওয়াত করে, তার উদাহরণ হচ্ছে রাইহানা বৃক্ষের মত যার সুগন্ধ রয়েছে, কিন্তু স্বাদে যা তিক্ত। আর সেই মুনাফিক যে কুর’আন তিলাওয়াত করে না, তার উদাহরণ হচ্ছে হানযালাহ্, যা স্বাদে তিক্ত এবং যার কোন গন্ধও নেই।” (বুখারী)
এই হাদীসে কুর’আনের মাহাত্ম্য ও উন্নত প্রকৃতি প্রকাশিত হয় – যা একজন মুনাফিকের মুখে উচ্চারিত হলেও তার সুগন্ধ পারিপার্শ্বিকতায় ছড়িয়ে পড়ে।
সবশেষে আমরা আরেকটি হাদীস উদ্ধৃত করবো যেখানে আল্লাহ কিতাবের গুরুত্ব যথাযথরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন :
“পবিত্র কুর’আন হয় তোমার পক্ষে অথবা তোমার বিপক্ষে সুপারিশ করে।” (মুসলিম)
এখানে আল্লাহর রাসূল (সা.) স্পষ্টত বলছেন যে, কুর’আন হয় কারো পক্ষে অথবা তার বিপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হবে। এখানে কোন নিরপেক্ষ অবস্থান নেই। যে কাউকে দুটো দলের একটির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এই বক্তব্য পবিত্র কুর’আনে আল্লাহর নিম্নলিখিত বক্তব্যের সদৃশ :
“এবং আমরা এই কুর’আন নাযিল করেছি যা বিশ্বাসীদের জন্য শিফা ও রহমত। আর জালিমদের জন্য এটা তাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না।” (সূরা ইসরা, ১৭:৮২)
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ৮
যারা কুর’আন জানতেন এবং কুর’আনকে জীবনে ধারণ করেছিলেন, কুর’আন সম্বন্ধে তাঁদের বক্তব্য
কুর’আন সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে, এরপর তাঁদের কাছে যাওয়া উচিত যাঁরা কুর’আনকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং এর পথনির্দেশক আলোর মাঝে জীবন যাপন করেছিলেন। এই শ্রেণীর শীর্ষে থাকবেন রাসূল(সা.)-এঁর সাহাবীগণ – যাঁরা তাদের কুর’আন শিক্ষার সিংহভাগ সরাসরি রাসূল (সা.)-এঁর কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। পবিত্র কুর’আন বলতে আসলে কি বোঝায়, তার সবচেয়ে সুন্দর ও যথার্থ বর্ণনার একটি এসেছে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী বিন আবু তালিবের (রা.) কাছ থেকে।
আলী (রা.) একদা বলেছিলেন :
“আল্লাহর কিতাবের সাথে লেগে থাকো, যা পূর্ববর্তীদের ও ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদের কথা বলে এবং স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ভাষায় ঐ সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে সত্য কথা বলে, যা নিয়ে তোমরা ভিন্নমত পোষণ কর। যে কেউ অহমিকাবশত এর অবহেলা করলো, আল্লাহ্ তাকে লাঞ্ছিত করবেন। আর যে কেউ অন্যত্র দিক নির্দেশনা খুঁজে বেড়ালো, আল্লাহ্ তাকে পথভ্রষ্ট করবেন। এটা হচ্ছে আল্লাহর সাথের যোগসূত্র, একমাত্র জ্ঞানগর্ভ বাণী এবং একমাত্র সঠিক পথ – যা কখনোই দুষ্ট চিত্ত দ্বারা বিকৃত হবে না অথবা দুষ্ট জিহ্বা দ্বারা পরিবর্তিত হবে না। এর রহস্য কখনোই অনাবৃত হবে না অথবা জ্ঞানীগুণীগণ এ থেকে জ্ঞানলাভ করে পরিতৃপ্ত হবে না। যে কেউ এর অনুযায়ী কথা বলে, সে সত্য কথা বললো ; যে কেউ এর অনুযায়ী কাজ করলো, সে পুরস্কৃত হবে ; যে এর দ্বারা শাসন করে, সে সুবিচার করলো ; এবং যে এর দিকে অন্যকে আহবান করে, সে সরল পথ দেখালো।”[আলবানীর মতে বক্তব্যটি আলী বিন আবু তালিবের (রা.)]
রাসূল (সা.)-এঁর সাহাবী এবং কুর’আন বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একদা বলেন, “কুর’আন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা ছাড়া কাউকে তার নিজের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। কেউ যদি কুর’আনকে ভালবাসে, তবে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে।” অপর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, “কেউ যখন কুর’আন পড়ে, তখন ব্যাপারটা অনেকটা একরম যেন তার উপর নবুওয়্যত নাযিল হচ্ছে, কেবল এটুকু ছাড়া যে তার কাছে কোন ওহী আসছে না। আর কেউ যখন কুর’আন পড়ে এবং বিশ্বাস করে যে তার কাছে যা রয়েছে তার চেয়ে ভাল কিছু অন্যের কাছে রয়েছে, তখন সে এমন কিছুকে মাহাত্ম্য দান করলো যেটাকে আল্লাহ্ ক্ষুদ্রতা দান করেছেন এবং এমন কিছুকে সে তুচ্ছ জ্ঞান করলো যাকে আল্লাহ্ মর্যাদা দিয়েছেন।”(আবু ইসহাক আল হুয়াইনি)
সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে যেমন বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবী, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যেন তিনি লোকজনকে আল্লাহর কিতাব শিক্ষা দিতে পারেন। সেই ইবনে আব্বাস (রা.) পবিত্র কুর’আন সম্বন্ধে বলেছেন:
“ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত এবং তিনি যে তোমাদের কুর’আনের জনগোষ্ঠী বানিয়েছেন, তা হচ্ছে তোমাদের প্রতি তাঁর করুণা।”
বাস্তবিকই, আর-রাহমান নামক সূরা, যেখানে আল্লাহ্ মানুষকে দান করা তাঁর বহু নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, সেই সূরার শুরুতে আল্লাহ্ বলেছেন :
“পরম দয়ালু আল্লাহ্(হে মানব তোমাদের) কুর’আন শিক্ষা দিয়েছেন (করুণাবশত)। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রাহমান, ৫৫:১-৩)
এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তাঁর দয়ার বশবর্তী হয়ে করা কাজ হিসেবে মানবতার সৃষ্টির আগে, মানুষকে কুর’আনের শিক্ষা দেওয়ার কাজকে স্থান দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কোন কোন জ্ঞানীজনেরা বলে থাকেন যে, উপরোক্ত আয়াতে এই ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহর কুর’আন শিক্ষাদানের কাজ, তাঁর মানবকুল সৃষ্টির কাজের চেয়ে অধিকতর বড় দয়ার নিদর্শন। এই তাফসীর বা ব্যাখ্যা, উপরে উদ্ধৃত কুর’আন সম্বন্ধে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) উক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
উসমান ইবনে আফফান (রা.) এবং হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) দুজনেই বলে গেছেন :
“হৃদয় যখন পবিত্র হয়, তখন তা কুর’আন পড়তে গিয়ে তৃপ্তি লাভ করে ক্ষান্ত হতে পারে না।(অর্থাৎ সে আরো বেশী বেশী করে কুর’আন পড়তে চাইবে)”
সুফিয়ান আস-সাওরী(রহ.), যিনি রাসূলের (সা.) সাহাবীদের শিষ্য ছিলেন – তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি জিহাদ অথবা কুর’আন পড়া – কোনটিকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, তিনি কুর’আন পড়াকে অগ্রাধিকার দেন এবং তিনি তাঁর পছন্দের দলিল হিসেবে নিম্নলিখিত হাদীসটির উল্লেখ করেন যা আমরা আগেও উদ্ধৃত করেছি :
“তোমাদের ভিতর সেই শ্রেষ্ঠ যে কুর’আন শিক্ষা করে ও অন্যদের তা শিক্ষা দেয়।”(বুখারী)
এ ব্যাপারে সাইয়্যিদ সাঈদ আবদুল গণি, সুফিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গী সমর্থন করে বলেন :
“সুফিয়ান আস-সাওরী যে জিহাদের উপর কুর’আনের তিলাওয়াতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কেননা এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারে, জিহাদে অংশগ্রহণ করার মত প্রয়োজনীয় গুণাবলী মুসলিম উম্মার অনেকের মাঝেই বিদ্যমান। কিন্তু যারা চমৎকার কুর’আন তিলাওয়াত করেন, যারা কুর’আনিক আইনের জ্ঞান রাখেন এবং যারা অন্য মুসলিমদের কুর’আন শিক্ষা দিতে পারেন – এমন ব্যক্তির সংখ্যা কম। সুতরাং তারা পিছনে থেকে মুসলিমদের আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা দেবেন – এই ব্যাপারটা তাদের জিহাদে অংশগ্রহণের চেয়ে নিঃসন্দেহে শ্রেয়। বিশেষত যে ক্ষেত্রে জিহাদে যাওয়াটা সম্প্রদায়ভিত্তিক দায়িত্ব (ফরযে কিফায়া) এবং অন্যেরা সে দায়িত্ব পালন করছেন – সে ক্ষেত্রে কুর’আন শেখা ও অন্য মুসলিমকে তা শিক্ষা দেওয়ার কাজটাই এক ধরনের জিহাদ।”
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ৯
কুর’আনের প্রতি একজন মুসলিমের দায়দায়িত্ব
দ্বীন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাসমূহের একটি হচ্ছে ‘আল ওয়ালার’ ধারণা – আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ধারণা – আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করার ধারণা। রাসূল (সা.) বলেছেন :
“ঈমানের সবচেয়ে শক্ত বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর ওয়াস্তে আনুগত্য, আল্লাহর জন্য অন্যের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করা, আল্লাহর জন্য (কাউকে) ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্য (কাউকে) ঘৃণা করা।” (আল তায়ালিসী, আল-হাকিম, আল-তাবারানী ইত্যাদি – আলবানীর মতে সহীহ)
আবদুল গণি মনে করেন, কারো মাঝে এই প্রয়োজনীয় আনুগত্য থাকার জন্য একটা প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে আল্লাহর কিতাবের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা থাকা – যা কিনা আল্লাহর বাণী এবং মানুষের কাছে প্রেরিত তাঁর ওহী। তাই সর্বাগ্রে একজন মুসলিমের পবিত্র কুর’আনের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকতে হবে। কিন্তু এই ভালবাসা কেবল একটা তাত্ত্বিক পর্যায়ে থাকাটা পর্যাপ্ত নয়। কুর’আনের প্রতি আমাদের আচরণে তা প্রতিফলিত হতে হবে – যার আওতায় কুর’আন পড়া, তা শিক্ষা করা (বা তা নিয়ে গবেষণা করা), তা মুখস্থ করা, কুর’আনের উপর কোন আক্রমণ প্রতিহত করা এবং কুর’আন অনুযায়ী জীবন যাপন করা – সবই এসে যাবে।
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের(সা.) প্রতি একজন ব্যক্তির যে ভালবাসা, তাই হচ্ছে কুর’আনের প্রতি তার ভালবাসার উৎস। কারো পক্ষে এরকম হওয়া সম্ভব নয় যে, সে আল্লাহকে ভালবাসবে অথচ আল্লাহর বাণী এবং মানবকুলের কাছে তাঁর ওহীকে ভালবাসবে না। বরং কেউ যে কুর’আনকে ভালবাসে, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকেও (সা.) ভালবাসে। বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “কেউ যদি পরখ করতে চায় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল(সা.)-কে ভালবাসে কিনা, তবে তার উচিত এই ব্যাপারটা যাচাই করা যে সে কুর’আন ভালবাসে কিনা – যদি সে কুর’আন ভালবাসে, তবে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে।” (আল-তাবারানী)
কুর’আন ভালবাসার সাথে সাথে, একজন ব্যক্তির এইজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, আল্লাহ্ আমাদের জন্য কুর’আন নাযিল করেছেন এবং তাঁর রাসূল(সা.)-কে পাঠিয়েছেন আমাদেরকে তাঁর কিতাব শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আল্লাহ্ নিজেই বিশ্বাসীদের তাঁর এই বিরাট নিয়ামতের কথা মনে করিয়ে দেন এবং সেই সাথে এও মনে করিয়ে দেন যে, এই কিতাব নাযিল হওয়ার পূর্বে বিশ্বাসীরা সত্য সম্বন্ধে জানত না এবং তারা বিপথগামী ছিল। আল্লাহ্ বলেন :
“বিশ্বাসীদের মাঝে, আল্লাহ্ তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করে তাদের উপর এক বিরাট অনুগ্রহ করেছেন, যিনি তাদের মাঝে আল্লাহর আয়াতসমূহ পড়ে শোনান, তাদের পবিত্র করেন, তাদেরকে হিকমত শিক্ষা দেন, অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্টত বিপথগামী ছিল।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৬৪)
আমাদের কাছে যে কুর’আন রয়েছে – এই বিশেষ অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে আমাদের উচিত কুর’আন পড়া ও শিক্ষা লাভ করা এবং কুর’আন ও এর শিক্ষার প্রতি পরবর্তীতে বিশ্বস্ত থাকা।
কুর’আনের প্রতি কারো দায়-দায়িত্বের ব্যাপারে রাসূলের (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসে তিনি বলেন :
“দ্বীন হচ্ছে নসীহাত।” লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, “কার প্রতি?” নবী (সা.) উত্তর দিলেন, “আল্লাহর প্রতি ও তাঁর কিতাবের প্রতি, এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ও মুসলিমদের নেতৃবৃন্দের প্রতি এবং সাধারণ মুসলিমদের প্রতি।” (মুসলিম)
এই হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, যে কারো আল্লাহর কিতাবের নসীহাত করা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, নসীহাত হচ্ছে এমন একটি শব্দ যার ভাষান্তর করা দুরূহ। শব্দটির ভাষাগত মূল ও কুর’আনে এর ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে আল রাগিব আল ইসফাহানী এর শরীয়াভিত্তিক সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : “নসীহাত হচ্ছে এমন একটা কর্মপন্থা বা বক্তব্যের সন্ধান করা যাতে অপর ব্যক্তির জন্য কল্যাণ ও উৎকর্ষের ব্যাপার রয়েছে।” ইবনে আল সালাহ বলেছেন যে, নসীহাতের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে এরকম যে, যিনি নসীহাত (বিশ্বস্তভাবে অন্যের মঙ্গল কামনা করা) করছেন, তিনি সত্যি সত্যি যাকে নসীহাত করছেন, তার জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম কল্যাণ কামনা করছেন। আরেকভাবে বলতে গেলে তার নিয়তে ও তার কর্মে তিনি অপর সেই ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম মঙ্গল কামনা করছেন।
কুর’আনের প্রতি বিশ্বাসীদের এই ধরনের মনোভাব থাকা উচিত। অর্থাৎ, কুর’আনের প্রতি আচরণে একজন বিশ্বাসীর বিশ্বস্ত হওয়া উচিত এবং এমন কাজ করা উচিত যা “এর জন্য কল্যাণকর” – এখানে যার অর্থ হবে এটা পড়া, এটা বোঝা, এবং জীবনে এর প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর কিতাবের প্রতি নসীহাতের কিছু অবশ্যকরণীয় দিক তুলে ধরে মুহাম্মাদ আল মারুযী বলেন:
“আল্লাহর কিতাবের জন্য নসীহাত বলতে বোঝায় এর প্রতি এক গভীর ভালবাসা ও বিরাট সম্মান পোষণ করা, যা এর প্রাপ্য – যেহেতু এটা সৃষ্টিকর্তার বাণী। এটা বোঝার জন্য প্রবল আগ্রহ এবং পড়তে গিয়ে এ থেকে, ‘কারো-প্রভু-কাউকে-যা-বোঝাতে-চেয়েছেন’, তা বুঝতে চেয়ে অবকাশ নিয়ে ভেবে দেখার জন্য বিরতি নেয়া – এ সবই নসীহাতের আওতায় আসে। তারপর একজন তা বোঝার পরে তাকে তা প্রয়োগও করতে হবে। কেউ যখন অন্যের কাছ থেকে নসীহাত লাভ করে, তখনও একই কথা প্রযোজ্য – সে যে উপদেশ লাভ করছে তা বুঝতে চেষ্টা করে। একইভাবে, সে যদি অন্য কোন ব্যক্তির কাছ থেকে লিখিতভাবে কোন কিছু পেয়ে থাকে, তবে সে চেষ্টা করবে সেই লেখাকে যথাসম্ভব ভালভাবে বুঝতে, যেন সে তা প্রয়োগ করতে পারে। আল্লাহর কিতাবের কাছ থেকে যে পরামর্শ গ্রহণ করছে, তার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য – সে তা বোঝার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, যাতে সে আল্লাহর ওয়াস্তে তা এমনভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, যা আল্লাহর কাছে সন্তোষজনক ও পছন্দনীয় দুটোই হবে। তারপর সে যা বুঝল তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। অতঃপর সে এর প্রতি ভালবাসা থেকে এর অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে থাকে – এর শিক্ষা দেয়া আচরণবিধি অনুযায়ী সে কাজ করে এবং এর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী সে আচরণ করে।”
উপরে আল মারুযী যা বলেছেন, তা ছাড়াও আল্লাহর কিতাবের প্রতি নসীহাতের অংশ হিসাবে কুর’আনের প্রতি সঠিক বিশ্বাসও উল্লেখযোগ্য: অর্থাৎ তা যে আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হয়েছে, তা যে আল্লাহর বাণী এবং তা আল্লাহর কথা – যা সৃষ্টি নয় – অর্থাৎ, এটা মানুষের কথার মত কোন কথা নয়। উপরন্তু আল্লাহর কিতাবের প্রতি সম্পূর্ণ নসীহাত এই দাবী রাখে যে, কেউ তার সামর্থ অনুযায়ী তা সঠিকভাবে পড়বে, প্রয়োগ করবে – এর সতর্কবাণী, শিক্ষা ও উপমা ইত্যাদি থেকে শিক্ষ গ্রহণ করবে। আল্লাহর কিতাবে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য অন্যদের প্রতি আহ্বানও এই নসীহাতের অংশ।
আল্লাহর কিতাবের প্রতি একজন বিশ্বাসীর আরেকটা অবশ্যকরণীয় কর্তব্য হচ্ছে এই যে, যে কোন বিষয়ে সে এটাকে চূড়ান্ত বিচারক বা ফায়সালাকারী হিসাবে মেনে নেবে – এটাই হবে সেই আইন, যা সে জীবনের সব ক্ষেত্রে মেনে চলবে। এই কিতাব যা কিছুকে হালাল বলে, সে সেটাকেই হালাল বলে গণ্য করে। এই কিতাব যা কিছুকে হারাম বলে, সে সেটাকেই হারাম বলে গণ্য করে। ধর্মীয় ও জাগতিক সব ব্যাপারই, অবশ্যই এই কিতাবের দিক নির্দেশনার আওতাধীন হতে হবে। আল্লাহ্ বলেন :
“……তোমরা যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ পোষণ কর, তবে সেটাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছে নিয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহয় ও শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাসী হয়ে থাক। চূড়ান্ত বিচারে সেটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম ও সবচেয়ে উপযোগী।” (সূরা নিসা, ৪:৫৯)
আল্লাহ্ আরো বলেন :
“কেউ যদি আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন, তা দ্বারা (অর্থাৎ তার আলোকে) বিচার করতে ব্যর্থ হয়, তারাই হচ্ছে (অবিশ্বাসী) কাফির।” (সূরা মায়িদা, ৫:৪৪)
এ বিষয়ে আবদুল গণি বলেন যে, আল্লাহর কিতাবের প্রতি বিশ্বস্ততার সর্বোচ্চ নিদর্শনের একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা করা। এটা হচ্ছে এই কিতাবের প্রতি একজন মুসলিমের বিশ্বস্ততার প্রকাশ্য ঘোষণা। একজন মুসলিম এই কিতাবখানিকে কতখানি ভালবাসে এবং কতখানি সম্মান করে তা বোঝানোর জন্য এটা (কুর’আন অনুযায়ী শাসন) হচ্ছে এক বাস্তব ও প্রায়োগিক প্রচেষ্টা। আল্লাহর আইন প্রয়োগ করা এবং তাঁর পবিত্র গ্রন্থ দ্বারা শাসন করা হচ্ছে ঈমানের এক অবশ্যকরণীয় দাবী, আকীদার এক উদ্দিষ্ট লক্ষ্য এবং তাওহীদের একটা ভিত্তি। এ থেকে মূর্খ ব্যক্তি, যার মূর্খতা ক্ষমা করা যায় না, অথবা একজন মুনাফিক, যার মুনাফিকী সর্বজনবিদিত, অথবা একজন কাফির যে তার প্রভুর প্রভুত্বকে অস্বীকার করে – এরা ছাড়া আর কেউ বিচ্যুত হবে না। কেননা, আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন করা হচ্ছে ইবাদতের কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে সর্ববৃহৎ একটি, যা দ্বারা মানুষ তার প্রভুর ইবাদত করে। এবং এটা হচ্ছে সবচেয়ে মহান কাজের একটি যা কাউকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে।
উপরে আমরা যা বললাম, তা ছাড়াও (কিন্তু তা সহ) আমাদের এই প্রচেষ্টার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, আমরা চেষ্টা করছি আল্লাহর কিতাবের প্রতি কারো অবশ্যকরণীয় যে নসীহাত তা পালন করতে – যখন আল্লাহর কিতাবের সাথে লেগে থাকা হয় না, যখন তা নিয়মিত অথবা গুরুত্বের সাথে পাঠ করা হয় না, যখন তার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয় অথবা সেটাকে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়, যখন এর সুমহান প্রজ্ঞাকে অবজ্ঞা করা হয়, যখন এর আইনসমূহকে আত্মসাৎ করা হয় ও মানবরচিত আইন দ্বারা সে সবকে প্রতিস্থাপিত করা হয় – তখন কারো অবশ্যকরণীয় হচ্ছে এই ট্র্যাজেডির অবসানকল্পে উঠে দাঁড়ানো এবং রুখে দাঁড়ানো। যা এই ট্র্যাজেডিকে আরো খারাপ দিকে নিয়ে যায় এবং যার মেরামত করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, তা হচ্ছে এই যে, প্রায়শই যারা কুর’আনে বিশ্বাস করেন তারা ভুল পন্থায় কুর’আনের নিকটবর্তী হন এবং একই সময়ে মনে করতে থাকেন যে, তারা তো কুর’আনকে সর্ববৃহৎ মর্যাদার আসন দান করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সম্মান প্রদর্শনের পন্থাও অনেক সময় ভ্রান্ত হয়ে থাকে। আমরা উপরে কুর’আনের প্রতি বিশ্বাসীদের যে দায়-দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছি, তা যদি তারা পালন না করেন, তবে বাস্তবে তারা আল্লাহর কিতাবের প্রতি নসীহাত করার অবশ্যকরণীয় কর্তব্য করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১০
আমরা গত কয়েকটা সংখ্যায় যে শিরোনামের আওতায় আলোচনা করলাম তা ছিল: কুর’আনের বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রতি আমাদের কর্তব্য। ঐ শিরোনামের আওতায় আলোচনার সারাংশ হচ্ছে এরকম:
এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট ও সাদামাটা তা হচ্ছে মুসলিমদের মনে করিয়ে দেওয়া যে, সত্যিকার অর্থে কুর’আন কী। উসমান ইবনে আফফান (রা.) ও আল হুজাইফা (রা.) বলেছিলেন যে, পবিত্র হৃদয় সম্পন্ন একজন ব্যক্তি যখন কুর’আনের বহু বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ অনুধাবন করতে পারবেন, তখন তিনি আরো অধিক হারে কুর’আন পাঠ করার ইচ্ছা পোষণ করবেন – তিনি কুর’আন শিক্ষা করতে চাইবেন; তখন তিনি আগ্রহ ভরে কিভাবে কুর’আনের নিকটবর্তী হওয়া উচিত এবং কুর’আনকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত তা জানতে চাইবেন। তখন তিনি বিশ্বস্ততার সাথে সঠিক উপায়ে কুর’আনকে প্রয়োগ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। যখন তিনি তা করবেন, ইনশা’আল্লাহ্, তার উপর কুর’আনের কাঙ্খিত প্রভাব বাস্তবায়িত হবে, ঠিক যেভাবে রাসূলের (সা.) সাহাবীদের উপর এর কাঙ্খিত প্রভাব পরিলতি হয়েছিল।
এরপর আমাদের যে আলোচনায় যে অধ্যায় আসবে তার শিরোনাম হচ্ছে:
কুর’আনিক প্রজন্ম : সঠিকভাবে কুর’আনের নিকটবর্তী হবার এবং সঠিকভাবে কুর’আন বোঝার ফলাফল
পবিত্র কুর’আন, যারা বিপথগামী ছিল তাদের বিশ্বাস, আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করতে বলেছিল। তা তাদের সত্যিকার সুখ ও সেই জীবনযাত্রার পথ নির্দেশনা দিতে এসেছিল – এ জীবনে যা প্রত্যেকের জন্য কাম্য ও অনুসরণীয়। পবিত্র কুর’আন বলে:
“তোমরা যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তাঁরা তোমাদের, যা তোমাদের জীবন দান করে, তার দিকে ডাকেন।….” (সূরা আনফাল, ৮:২৪)
আল সুদ্দী, যিনি পবিত্র কুর’আনের প্রথম যুগীয় একজন মুফাসসির ছিলেন, তিনি বলেন যে, এই আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে এরকম যে, সাহাবীরা সত্যিকার অর্থে অবিশ্বাসের মাঝে মৃত অবস্থায় ছিলেন – যখন ইসলাম এসে তাদের প্রকৃত জীবন দান করলো।
ঈমান ও কুফরের ভিতর পার্থক্য আসলে জীবন ও মৃত্যুর ভিতর পার্থক্যের সাথে তুলনীয়। কুর’আন জানা অর্থাৎ ঐ প্রাণের উৎস যার প্রতি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল(সা.) প্রতিটি মানুষকে ডাকেন – সেটাকে জানা এবং সেটা না জানার ভিতর তফাৎটা জীবন ও মৃত্যুর ভিতর তফাতের সাথে তুলনীয়।
প্রথম প্রজন্মের মুসলিমদের উপর কুর’আনের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এঁরা হচ্ছেন সেই প্রজন্ম, কুর’আন যাঁদের জীবন দিয়েছিল। তাঁদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন, পরবর্তী সকল প্রজন্মের যারা কুর’আনে বিশ্বাস করেন, তাদের অবশ্যই ঐ দৃষ্টান্তে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্খা থাকা উচিত।
মুহাম্মাদ(সা.)-এঁর আগমনের পূর্বের পৃথিবী
‘ইসলাম এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে আবুল হাসান আলী নাদভী রাসূলের(সা.) আগমনের পূর্বের পৃথিবীর অবস্থা চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। নাদভী ঐ সময়কার পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির দশার বর্ণনা করেছেন। আমরা নীচে তার বর্ণনা থেকে অল্প কিছু উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেন :
“এটা সর্বজনবিদিত যে, ঈসায়ী ষষ্ঠ শতাব্দী মানব জাতির জন্য সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক অধ্যায় ছিল। মানবতা তখন এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছিল, যার সাথে কোন পাহাড়ের ঐ প্রান্তসীমার তুলনা করা চলে, যার নীচে রয়েছে গভীর খাদ – শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবক্ষয়ের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে যে পরিণতির দিকে তা এগিয়ে গেছে। এবং মনে হচ্ছিল যে সারা বিশ্বে এমন কোন উপায় বা ক্ষমতা নেই, যা এসে তাকে উদ্ধার করবে ও ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।”
উপরোক্ত বক্তব্যের পরে, তিনি তৎকালীন রোমান ও পারসিক সভ্যতার অবস্থা বর্ণনা করেন – যারা তৎকালীন দুটো প্রধান উল্লেখযোগ্য সভ্যতা ছিল। তিনি বলেন যে, তারা তখন সম্পূর্ণরূপে নৈতিকতা বিবর্জিত অবস্থায় পতিত হয়েছিল। তারা তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার বদ্ধমূল পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল।
ঐ সময়কার জনগোষ্ঠীগুলির নৈতিকতার যে দুরবস্থা ছিল, ধর্মকর্ম হয়তো তাদের জন্য ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু পশ্চিমা শক্তির মুখ্য ধর্ম অর্থাৎ খৃস্ট ধর্ম ইতোমধ্যেই তার প্রধান শিক্ষাগুলো হারিয়ে ফেলেছিল। তা তখন গ্রীক উপকথা, রোমান মূর্তিপূজা, মিশরীয় নব্য প্লেটোবাদ ও সন্ন্যাসবাদ ইত্যাদির সংমিশ্রণে এমন এক জগাখিচুড়ীতে পরিণত হয়েছিল যে, তার নিজেরই তখন সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। একই ধরনের অন্যান্য সমস্যার জন্য ইহুদী ধর্ম বা ইহুদীরা তখনকার বিরাজমান অবস্থায় খুব একটা কার্যকরী অবদান রাখতে অম ছিল।
‘দ্য মেকিং অব হিউম্যানিটি’ বইতে রবার্ট ব্রিফল্ট বলেন :
“পঞ্চম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ বর্বরতার এক অমানিশার মাঝে নিমজ্জিত ছিল, যা ক্রমাগত অন্ধকার থেকে অন্ধকারতর হয়েছে। এই বর্বরতা প্রাথমিক যুগের বন্য আচার-আচরণের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল – কেননা তা ছিল এককালের এক মহান সভ্যতার পচনশীল মৃতদেহের মত। ঐ মহান সভ্যতার বৈশিষ্ট্য এবং ছাপ সম্পূর্ণভাবে মুছে গিয়েছিল। ইটালী এবং গলের মত যে সমস্ত জায়গায় সভ্যতা সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছিল, সে সব জায়গাগুলোতে কেবল ধ্বংসাবশেষ, আবর্জনা ও অবলুপ্তির চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল।”
নাদভী তাঁর বর্ণনায় উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ, ইরান, মধ্য এশিয়া (ভারতবর্ষ) এবং চীন নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করেন। তিনি বুদ্ধিজম, হিন্দুইজম ও অন্যান্য ধর্ম নিয়েও আলোচনা করেন। ঐ সমস্ত এলাকার ও ধর্মসমূহের দশা ইউরোপ ও খৃস্টধর্মের মতই ছিল। এ সমস্ত এলাকা ও ধর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে এটুকুই বুঝতে পারা যথেষ্ট যে, বিশ্ব-মানবতা তখন নিশ্চিতভাবেই এক হতাশাব্যঞ্জক অবস্থায় ছিল। ঐ সময় পৃথিবীর কোন অংশ থেকেই সত্যিকার অর্থে সত্যের দিকে পথ-নিদের্শনার কোন আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল না।
আমাদের এই “সিরিজ আলোচনার” জন্য যারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই আরবদের দশাও পৃথিবীর অন্যান্যদের চেয়ে বিশেষ ভিন্ন কিছু ছিল না। সে যাহোক, পবিত্র কুর’আন যেহেতু তাদের কাছেই প্রথম উপস্থাপিত হয়েছিল এবং তারাই যেহেতু সর্বপ্রথম এর শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল – আমরা এখানে তাদের অবস্থা সম্বন্ধে একটু বিস্তারিত আলোচনায় যাব।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১১
রাসূলের (সা.) আগমনের পূর্বের আরবগণ
ঐ সময়কার অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতই আরবদের মাঝে দোষ ও গুণ দুটোই ছিল। কিন্তু অন্য সব জাতির মত তাদের মাঝেও কিছু বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য ছিল – তাদের দোষ ছিল বহুবিধ এবং তাদের গুণগুলো ছিল বিকৃত।
আবদুল হামিদ সিদ্দিকী তাঁর বই, ‘দ্য লাইফ অফ মোহাম্মদ’ এর শুরুতে ইসলামপূর্বক জাহিলী আরবদের একটি সাধারণ পরিচয় তুলে ধরেন। ইসলামের আগমনের পূর্বে আরবী কবিতাতে বর্ণিত সে যুগের আচার-আচরণ ও বিশ্বাস ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে। তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে মূর্তিপূজা, শরীরী সুখের প্রতি আসক্তি, গোত্রভিত্তিক মর্যাদা, আন্তঃগোত্র যুদ্ধ, মূর্খতা এবং মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞা ও অসম্মান ইত্যাদির কথা এসেছে।
শরীরী সুখের প্রতি তাদের আসক্তির বর্ণনায় সিদ্দিকী লেখেন:
“মদ্যপান আরবদের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনিতে মদ্যপানের সাথে মেয়ে মানুষের একটা সম্পর্ক তো আছেই – যেজন্য অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপানের সাথে সাথে ব্যভিচার ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। মক্কা থেকে নিজস্ব পণ্য নিয়ে যেসব কাফেলা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, সিরিয়া, পারস্য ও ভারতবর্ষে যেত, সেগুলো সেসব জায়গা থেকে নানাবিধ বিলাসিতা ও পাপাচার এবং সিরিয়া ও ইরাক থেকে ক্রীতদাসী আমদানী করে ঘরে ফিরতো – যারা নেচে ও গেয়ে ধনী ব্যক্তিদের শরীরী সুখের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করতো, যার সাথে স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য পাপাচারও যুক্ত হতো। ……………….।
……ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব জনগণের মদ্যপানের মহোৎসবের অনেক বর্ণনা রয়েছে পুরাতন আরবী কবিতাগুলোতে………………।
… বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্রতার প্রতি পৌত্তলিক আরবদের সম্ভ্রমবোধ ছিল খুবই নগণ্য। বরং বৈবাহিক বন্ধনের মর্যাদাকে অবজ্ঞা করা ও জনসমক্ষে বিবাহ-বহির্ভূত ব্যভিচার বর্ণনা করাতে তারা এক ধরনের গর্ববোধ করতো।”
আবারো প্রাক-ইসলামী যুগের আরবে মেয়েদের অবস্থান কি ছিল তা নিয়ে বলতে গিয়ে সিদ্দিকী প্রাক-ইসলামী আরবী কবিতার সূত্র ধরে বলছেন:
“মেয়ে শিশুদেরকে কেবল জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো তাই নয়, বরং যারা তা থেকে অব্যাহতি পেতো তাদের জীবনটা কাটতো অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্ভোগের মধ্যে। তারা অনেকটা বাজারজাত করা যায়, এমন এক ধরনের পণ্য বলে বিবেচিত হতো – খোলাবাজারে সর্বোচ্চ মূল্য প্রদানকারীদের কাছে তাদের বিক্রি করা হতো। যখন তাদের স্বামীর মালিকানায় সোপর্দ করা হতো, ততদিনে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হতো। বিয়েটা তাদের জন্য এক ধরনের দাসত্ব ছিল এবং তাদের উপর স্বামীর অধিকার অনেকটা প্রভুত্বের অধিকারের মত ছিল – সে (স্বামী) ইচ্ছেমত তার সম্পত্তিকে ব্যবহার ও ত্যাগ করতে পারতো।”
আল্লাহর ইচ্ছায় পবিত্র কুর’আনের মাধ্যমে আরবদের জীবনে যে পরিবর্তন ঘটে
এটা পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, রাসূলের (সা.) সময়কার আরবরা মদ্যপান করতে চাইতো, ফুর্তিতে মেতে থাকতো ও আন্তঃগোত্র যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করতো। কখনো তারা তাদের কন্যা সন্তানকে হত্যা করতো। কিন্তু কেউ ভেবে দেখলে দেখতে পাবেন যে, আল্লাহর দয়া এবং পবিত্র কুর’আনের অলৌকিক প্রভাববশত, মাত্র একজন মানুষ দ্বারা সূচিত আন্দোলনের মাধ্যমে, প্রায় বিশ বছর সময়কালের ব্যবধানে প্রায় সব আরব ও আরবীয় উপদ্বীপের অনারবদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। এবং বিশ্বাস ও স্নেহ-মায়া ভিত্তিক এক ভ্রাতৃত্ববোধ তাদের এমনভাবে একত্র করেছিল যে, ঐ (মুসলিম) সম্প্রদায়ের একটি অংশ কোন অসুবিধায় পড়লে, গোটা সম্প্রদায়ের উপরেই তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলতি হতো। পূর্বেকার জাতশত্রু দু’টো গোত্রের সদস্যকেও তখন দেখা যেতো নিজেদের ভিতর সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে এবং একে অপরের জন্য জীবন দিতে এগিয়ে যেতে। এমনকি ঐ সময়ে একজন তার সম্পদের অর্ধেক এবং নিজের স্ত্রীদের একজনকে তালাক দিয়ে তার নতুন ভাইয়ের জন্য ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করতো না – যদিও বা সেই নতুন ভাই এক ভিনদেশী গোত্রের সদস্য হতেন।
ইসলাম এসে তৎকালীন আরবদের জীবনে কি ধরনের পরিবর্তন সাধন করেছিল, তার সবচেয়ে সুন্দর বর্ণনার একটি পাওয়া যাবে সাহাবী জাফর বিন আবু তালিবের (রা.) বক্তব্যে – রাসূলের (সা.) মিশন সম্বন্ধে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি যখন বলেছিলেন, “হে রাজা, আমরা ছিলাম এক মূর্খ জনগোষ্ঠী, যারা মূর্তিপূজা করতো, মৃত পশুর গোশত খেত এবং যৌনসুখে গা ভাসিয়ে দিত। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের উত্যক্ত করতাম, ভাই তার ভাইকে অত্যাচার করতো এবং সবল দুর্বলের সম্পদ আত্মসাৎ করতো। এরকম একটা সময়ে আমাদের মাঝে এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল – যিনি ইতোমধ্যেই সকলের কাছে সত্যবাদী, উন্নত চরিত্রের এবং সৎ ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। এই মানুষটি আমাদের ইসলামের পথে ডাকলেন। এবং তিনি আমাদের পাথর পূজা থেকে নিবৃত্ত হবার, সত্য কথা বলবার, রক্তপাত ত্যাগ করবার, এবং এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। তিনি আমাদের প্রতিবেশীদের ভালবাসতে শিখিয়েছেন এবং সতী নারীদের কুৎসা রটনা থেকে বিরত থাকতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদের সালাত আদায় করতে, রোজা রাখতে এবং যাকাত দিতে আদেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁকে অনুসরণ করেছি, বহু ঈশ্বরবাদ ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেছি এবং সকল কুকর্ম থেকে বিরত থেকেছি। এই নতুন পথ বেছে নেয়ার জন্য আমাদের মানুষজনেরা আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে এবং তারা আমাদের পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট জীবন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য করতে চায়।”
ঐ প্রজন্ম পর্যায়ক্রমে ইসলামের সেই বাণী – বাকী পৃথিবীতে পৌঁছে দেন। স্পষ্টতই তাঁরা ছিলেন এমন এক প্রজন্ম যাঁদের অন্ধকার থেকে আলোতে এবং আল্লাহর ‘সরল পথে’ নিয়ে যাওয়া হয়। পারস্য সম্রাট যখন মুসলিমদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তাঁরা কি জন্য ঐ সাম্রাজ্যে আগমন করেছেন – তখন দুজন ভিন্ন সাহাবী একই ধরনের উত্তর করেছিলেন : “যারা চাইবে, তাদেরকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও এই পৃথিবীর সংকীর্ণতা থেকে এর প্রশস্ততায় এবং (দুনিয়ার) জীবনের অবিচার থেকে ইসলামের সুবিচারে নিয়ে যেতে আল্লাহ্ আমাদের পাঠিয়েছেন।”
নবীর জীবদ্দশায় ঐ মানুষগুলো কিভাবে আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার আশা করে পরহেজগার এক প্রজন্মে রূপান্তরিত হয়েছিলেন সেটা সবার জানা। এমনকি মানুষ হিসাবে তাঁদের কেউ যখন কোন ভুল করে কোন পাপের রাস্তায় পা রেখেছিলেন, তাঁরা যথাশীঘ্র সম্ভব সেজন্য তওবা করেছেন এবং আল্লাহর ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন। আল্লাহর কাছে পাপপূর্ণ আমল নিয়ে যাবার চেয়ে তাঁরা বরং এই পৃথিবীতে, এমনকি, মৃত্যুদণ্ডের মত কঠোর শাস্তি বরণ করে নেয়াটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। মায়িয ইবনে মালিক আল আসলামী এবং আল গামিদিয়াহ্ নামক অপর একজন মহিলার ক্ষেত্রে আমরা এ ধরনের ব্যাপার দেখতে পাই। তাঁরা দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় রাসূলের (সা.) কাছে এসেছিলেন তাদের ব্যভিচারের স্বীকারোক্তি নিয়ে এবং দুজনেই আল্লাহর রাসূলের কাছে প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুর মাধ্যমে পার্থিব শাস্তির আবেদন করেছিলেন – যাতে আখিরাতে তাঁরা পাপের বোঝা সমেত আল্লাহর সামনে উপস্থিত না হন। আল গামিদিয়াহর বেলায় রাসূল (সা.) তাঁকে তাঁর স্বীকারোক্তির পর বলেছিলেন যে, তিনি যেন তার গর্ভস্থ সন্তান প্রসবের পরে রাসূলের (সা.) কাছে ফিরে আসেন। এরপর তিনি তাঁর পাপের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে, সন্তান কোলে ঠিকই রাসূলের (সা.) কাছে ফিরে এসেছিলেন। নবী তখন তাঁকে তাঁর সন্তানের স্তন্য পানের সময়কাল অতিবাহিত করে পুনরায় তাঁর কাছে ফিরে আসতে বলেন। কিছুকাল পরে মহিলা ঠিকই ফিরে এলেন এবং তাঁর সন্তানের আর মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন নেই – এই তথ্য সমেত তিনি রাসূলের (সা.) কাছে তাঁর গুনাহ থেকে পরিশুদ্ধ হবার আবেদন জানালেন। এমতাবস্থায় শেষ পর্যন্ত নবী(সা.) তাঁর দণ্ডপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করলেন এবং আল গামিদিয়াহ্ প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুবরণ করে তাঁর ব্যভিচারের শাস্তি গ্রহণ করলেন। রাসূল (সা.) তাঁর প্রায়শ্চিত্তের পদক্ষেপকে প্রশংসা করে গেছেন। (মুসলিম)
সাহাবীদের ভিতর ইসলাম যে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিল, তার ধারা রাসূলের (সা.) মৃত্যুর অনেক পর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সাহাবীরা বাকী গোটা পৃথিবীর কাছে ইসলাম পৌঁছে দিতে যেভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তার একটা বর্ণনা আমরা নীচে তুলে দিচ্ছি, যেখান থেকে পাঠক ইসলামের পথে তাঁদের অব্যাহত যাত্রার একটা ধারণা লাভ করতে পারবেন :
একজন রোমান কর্মকর্তা মুসলিম সৈন্যদের নিখাদ চরিত্র ও গুণাবলীর বর্ণনা করেছিলেন এই বলে : ‘রাত্রে তাদের ইবাদতরত অবস্থায় দেখা যাবে, দিনে রোজা রাখা অবস্থায়। তারা তাদের ওয়াদা রক্ষা করেন, সৎকাজের আদেশ করেন, মন্দ অনুভূতি দমিয়ে রাখেন এবং নিজেদের মাঝে পূর্ণ সাম্য বজায় রাখেন।’ আরেকজন সাক্ষ্য দেয় : ‘তারা দিনে অশ্বারোহী, রাতে দরবেশ। তারা অধিকৃত এলাকায় যা কিছু আহার করে, তার মূল্য পরিশোধ করে; কোথাও পৌঁছালে তারা আগে অভিবাদন জানায় এবং তারা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ যোদ্ধা যারা শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে।’ তৃতীয়জন বলেছে : ‘রাতের বেলা মনে হবে তারা যেন এই দুনিয়ার কেউ নয় এবং ইবাদত ছাড়া তাদের কোন কাজ নেই। আর দিনের বেলা যখন কেউ তাদের ঘোড়ার পিঠে দেখবে ; তখন মনে হবে সারাজীবন তারা এ (যুদ্ধ) ছাড়া আর কিছুই করে না। তারা হচ্ছে চৌকস তীরন্দাজ ও দুর্ধর্ষ বর্শা নিপেকারী, তথাপি তারা অত্যন্ত বিশ্বস্ত ধার্মিক এবং তারা সার্বক্ষণিকভাবে ঈশ্বরকে এমনভাবে স্মরণ করতে থাকে যে, তাদের সাহচর্যে, কেউ তাদেরকে অন্য কোন বিষয়ে প্রায় কথা বলতেই শোনে না।’
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১২
রাসূল (সা.) কি উৎসমূল ছিলেন?
কেউ এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে, ঐ প্রজন্মের উৎকর্ষের পিছনে সম্ভবত রাসূলের (সা.) অস্তিত্ব, শিক্ষা এবং নেতৃত্ব ইত্যাদিই ছিল প্রধান কারণ – সুতরাং তাঁদের ঐ বিশাল পরিবর্তনের মূলে রয়েছে তাঁদের মাঝে রাসূলের (সা.) উপস্থিতি। এটা প্রশ্নাতীত যে, রাসূল (সা.) এবং তাঁর দৃষ্টান্ত তাঁর অনুসারীদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কোন জনগোষ্ঠীর উপর পবিত্র কুর’আনের কাঙ্খিত ফলাফলের জন্য তাঁর শারীরিক উপস্থিতি অনিবার্য! পরবর্তী প্রজন্মের উপরও কুর’আন একই রকম প্রভাব ফেলতে সক্ষম, এমনকি রাসূলের (সা.) অনুপস্থিতিতেও। সাইয়েদ কুতুব তার ‘মাইল স্টোন্স’ বইতে এই ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন :
“যে কুর’আন এই বাণী ধারণ করে, তা এখনো আমাদের হাতে আছে। আর প্রথম প্রজন্মের মুসলিমগণ, যাঁদের ইতিহাসে কোন জুড়ি নেই, তাঁদের কাছে যেমন বাস্তব জীবনের কর্মকান্ডে রাসূলের (সা.) দিক নির্দেশনা বর্তমান ছিল, তেমনি সেসব এবং তাঁর পবিত্র জীবনের ঘটনাবলী এখনও অক্ষত অবস্থায় হাদীসের আকারে সংকলিত রয়েছে। পার্থক্য শুধু এই যে, এখন নবী (সা.) নেই – কিন্তু এটাই কি গূঢ় রহস্য? যদি ব্যক্তি রাসূলের (সা.) উপস্থিতি এই বাণীর প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের জন্য অনিবার্যই হতো, তাহলে আল্লাহ্ ইসলামকে এক বিশ্বজনীন বাণী হিসেবে নির্ধারিত করতেন না, গোটা মানবতার জন্য এটাকে ধর্ম হিসাবে নির্ধারণ করতেন না, এই বাণীকে মানবতার জন্য সর্বশেষ ঐশী বাণী হিসাবে মর্যাদা দিতেন না এবং সময়ের সমাপ্তি পর্যন্ত এই গ্রহের সকল অধিবাসীর জন্য এটাকে পথ নির্দেশক হিসেবে ঠিক করে দিতেন না।
আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনের সংরক্ষণের দায়-দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছেন। কেননা তিনি জানেন যে, এমনকি নবীর (সা.) যুগের পরেও, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং তা থেকে মানবকুল লাভবান হওয়া সম্ভব। সেজন্যই তেইশ বছরের নবুওয়্যতের জীবনের পরে, তিনি তাঁর নবীকে তাঁর করুণার ছায়াতলে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং এই দ্বীনকে শেষ সময় পর্যন্ত প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করেছেন। নবীর(সা.) অনুপস্থিতি তাই এ ব্যাপারের (অর্থাৎ বর্তমান অবক্ষয়ের) কোন কারণ বা ব্যাখ্যা নয়।”
পবিত্র কুর’আন এবং রাসূল(সা.) এ ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেন যে, ইসলামের শিক্ষা দ্বারা মানবকুলকে পথ-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য এবং মানুষের উপর এর কাঙ্খিত সুফলের জন্য, রাসূলের (সা.) ব্যক্তিগত উপস্থিতি অনিবার্য নয়। কুর’আন সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুর’আনে বলেন:
“হে আহলে কিতাব! তোমাদের কাছে আমাদের রাসূল এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা কিছু লুকিয়ে রাখতে তা প্রকাশ করতে এবং যা কিছু অপ্রয়োজনীয় তা বাদ দিতে। আল্লাহর কাছ থেকে তোমাদের কাছে এক (নতুন) আলো এবং হেদায়েত দানকারী গ্রন্থ এসেছে। যা দিয়ে আল্লাহ্ তাদের সকলকে পথ নিদের্শনা দেন যারা শান্তি ও নিরাপত্তার পথে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তাদের তাঁর ইচ্ছামত অন্ধকার থেকে সেই আলোতে বের করে নিয়ে এসে সেই পথে পরিচালিত করেন যা সরল।” (সূরা মায়িদা, ৫:১৫-১৬)
এই আয়াতদ্বয় স্পষ্টত বলছে যে, কিয়ামতের দিন পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য এক পথনির্দেশক হিসাবে কুর’আন স্বয়ংসম্পূর্ণ – যা মানুষকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে যায়। রাসূল (সা.) বলেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, যার পরে তোমরা আর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, সেটি হচ্ছে আল্লাহ্্র কিতাব।”(মুসলিম)
সুতরাং, মুহাম্মাদ কুতুব যেমন বলেছেন, একটা নির্ভেজাল মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূলের (সা.) উপস্থিতি কোন পূর্বশর্ত নয়। যদিও একভাবে ভাবতে গেলে শারীরিকভাবে মৃত হয়েও রাসূল (দঃ) আমাদের মাঝেই রয়েছেন, কেননা তাঁর উদাহরণ এবং তাঁর শিক্ষা এমন স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে যে, যে কেউ চাইলে আজো তাঁর শিক্ষা ও তাঁর দিক-নির্দেশনা এমনভাবে জানতে পারবে, ঠিক যেমনটি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে দেখে জানা যেতো।
আল্লাহ্ যেভাবে কুর’আনকে সংরক্ষণ করেছেন, সেরকম ভাবেই রাসূলের (সা.) উদাহরণের এই দিকটিকে তিনিই হেফাজত করেছেন। তাই প্রথম প্রজন্মের মুসলিমরা যেভাবে রাসূলের (সা.) উদাহরণের দিকে ফিরে যেতেন – সেভাবে আজো কেউ চাইলে কোন ফায়সালার জন্য রাসূলের (সা.) উদাহরণের দিকে ফিরে যেতে পারে।
রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। মানুষজনের জন্য সত্য জানতে ও তা অনুসরণ করতে প্রতিটি প্রজন্মে তাঁর শারীরিক উপস্থিতির আবশ্যকতা নেই। উপরন্তু কুর’আন থেকে এবং তিনি যে সত্য নিয়ে এসেছিলেন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবার জন্য তাঁর মৃত্যুটা কোন অজুহাত হতে পারে না, যেমন আল্লাহ্ বলেন :
“মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নন, তার আগেও এমন অনেক রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তোমরা কি তাহলে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে (এবং কুর’আনের ও তাঁর সুন্নাহর দিক নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করবে)? কেউ পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করলে সে আল্লাহর বিন্দুমাত্র ক্ষতিও করতে পারবে না।…..” (সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৪৪)
নবী মুহাম্মাদ (সা.) যেহেতু শেষ নবী ও রাসূল ছিলেন, সেহেতু এরকম না হলে তো আল্লাহ্ তাঁকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত জীবিত থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন, যাতে বিচার দিবসে মানুষের তরফ থেকে আল্লাহর বিরুদ্ধে অবিচারের কোন অভিযোগ করার অবকাশ না থাকে। মানুষ দাবী করতে পারতো যে, তাদের সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য যা অত্যাবশ্যকীয় ছিল, আল্লাহ্ তাদের জন্য তা দান করেননি বা সংরক্ষণ করেননি।
কিন্তু পবিত্র কুর’আন তার মূল রূপে আজো বর্তমান এবং নবীর (সা.) সুন্নাহও সংরক্ষিত রয়েছে। তাহলে আজকালকার কুর’আনে বিশ্বাসীদের মাঝে এবং অতীতে যারা কুর’আনে বিশ্বাস এনেছিলেন, তাদের মাঝে এত দুস্তর ব্যবধান কেন? এখন তাহলে এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা আবশ্যক।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৩
বর্তমান সময়ে পবিত্র কুর’আনের একই ধরনের প্রভাব নেই কেন?
গ্রেট ব্রিটেনের চার কার্যকালের প্রধানমন্ত্রী, উইলিয়াম ইওয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোন ইংলিশ পার্লামেন্টে দেওয়া তার ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “যতদিন পর্যন্ত এই কুর’আন রয়েছে, ইউরোপ কখনোই ইসলামী প্রাচ্যকে জয় করতে পারবে না।” একইভাবে আলজিরিয়া দখলের শতবর্ষ পূর্তি উপলে সেখানকার ফরাসী ঔপনিবেশিক গভর্ণর বলেছিলেন, “যদি আমরা তাদের উপর বিজয়ী হতে চাই তবে, তাদের মাঝ থেকে আরবী কুর’আন সরিয়ে ফেলা এবং তাদের জিহ্বা থেকে আরবী ভাষা সরিয়ে ফেলা এক অবশ্যকরণীয় কর্তব্য ।”
আসলে ইসলামের অনেক শত্রুরাই আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অনুধাবন করেছে : “মুসলিমদের হাত থেকে শারীরিকভাবে পবিত্র কুর’আন ছিনিয়ে নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মুসলিম জীবনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে কেবল কুর’আনকে সরিয়ে নিলেই হবে (অর্থাৎ মুসলিম জীবনের সকল কর্মকান্ড যে কেবল কুর’আনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়, এই প্রক্রিয়ার অবসান ঘটাতে পারলেই ইসলামের শত্র“দের মুখ্য কার্য সমাধা হবে)”। মুসলিমদের জন্য এটা খুবই সম্ভাব্য যে, তাদের হাতে কুর’আন থাকবে, অথচ তারা তা থেকে লাভবান হতে পারবে না, – অথবা সেই পথনির্দেশনা এবং সেই রহমত লাভ করতে পারবে না – যা পবিত্র কুর’আনের কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবেই লাভ করার কথা ছিল।
আজ যে পবিত্র কুর’আনের সেই কাঙ্খিত সুফল পরিলক্ষত হয় না, তার সাথে কুর’আনের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির কোন সম্পর্ক নেই – কেননা মানবকুলকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাবার জন্য, তা সর্বকালের জন্যই সত্যিকার পথ-নির্দেশক হয়ে থাকবে। সমস্যার উৎস নিহিত রয়েছে আজকের বহু বিশ্বাসী যেভাবে কুর’আনের নিকটবর্তী হন, তার মাঝে। আজকের দুরবস্থার জন্য বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে সাধারণভাবে চারটি কারণ খুব প্রকটভাবে অনুভূত হয়, যে সম্বন্ধে আমরা সূচনার অধ্যায়ের আলোকপাত করেছি :
১) কিছু মুসলিম যেমন করে থাকেন – পবিত্র কুর’আনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক দিকগুলো অবজ্ঞা করে গৌণ দিকগুলোকে প্রাধান্য দেয়া।
২) উপরের এক নম্বর পয়েন্টের সাথে এটাও সম্পৃক্ত – বহু সংখ্যক মুসলিম পবিত্র কুর’আনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সনাক্ত করতে ও বুঝতে ব্যর্থ হন; সুতরাং তারা কুর’আন পড়েন, কিন্তু তাদের জন্য কুর’আন যা চায় – তা সেখান থেকে গ্রহণ করতে পারেন না।
৩) উপরন্তু, কিছু মুসলিম সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী সহকারে কুর’আনের নিকটবর্তী হতে পারেন না, আর তাই ‘কুর’আন যা শিক্ষা দেয়’ এবং ‘সেই শিক্ষা কিভাবে মানবকুলকে প্রভাবিত করতে পারে’ – এই দুয়ের মাঝে অত্যাবশ্যকীয় যোগসূত্রটি তারা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হন।
৪) উপরোল্লিখিত বাধাগুলো যখন অতিক্রম করা হয় তখনও, কিছু মুসলিম কুর’আনকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করেন না, আর তাই তারা যদিবা কুর’আন পড়েনও – তা থেকে সঠিক ও শুদ্ধ শিক্ষা লাভ করতে পারেন না।
আমাদের বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উপরোক্ত বিষয়গুলো রয়েছে। আমরা তাই পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এক এক করে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্!
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৪
আল্লাহর জন্য বিশ্বস্তভাবে পবিত্র কুর’আনকে অনুসরণ করার চিরস্থায়ী ফলাফল
পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন যে, এই অধ্যায়ের যে অংশটুকু আমরা ইতোমধ্যে পার হয়ে এসেছি, সে অংশে আমরা এই পৃথিবীর জীবনে পবিত্র কুর’আনের প্রভাব নিয়ে মূলত আলোচনা করেছি। আরো এগিয়ে যাবার আগে, কুর’আনের সাথে লেগে থাকার ফলে আমাদের উপর এর চিরস্থায়ী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে এই পৃথিবীর জীবনে কুর’আনের প্রভাবের চেয়ে বরং চিরস্থায়ী জীবনের উপর কুর’আনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ – যদিও দুটো দিকই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পবিত্র কুর’আন নাযিল হয়েছে মানুষকে এই জীবনের কর্মকান্ডে দিক নির্দেশনা দিতে, যাতে সে আল্লার কাছে পছন্দনীয় হয় এবং আল্লাহর রহমত ও জান্নাতের পথে পরিচালিত হয়। পৃথিবীতে কুর’আনকে অনুসরণ করার ফলে যদি উদ্দিষ্ট ও কাঙ্খিত ফলাফল না পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হবে যে, পবিত্র কুর’আনকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী সহকারে দেখা, বোঝা বা অনুসরণ করা হয়নি। আর ব্যাপারটা যদি সেরকমই হয়, তবে কেউ যেমন পার্থিব জীবনে কুর’আনের সুফল লাভ করতে ব্যর্থ হতে পারেন, তেমনি আরো দুঃখজনকভাবে কুর’আনের পারলৌকিক সুফল থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন।
এ সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা‘আলা কুর’আনে বলেন :
“……….যে কেউ আমার দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করলে তাদের জন্য ভয়ের বা দুঃখের কোন কারণ থাকবে না। যারা অবিশ্বাসী এবং যারা আমাদের আয়াতসমূহের ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করে, তারা হচ্ছে জ্বলন্ত আগুনের বাসিন্দা এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাক্বারা, ২:৩৮-৩৯)
কুর’আন অনুসরণ করার সুফল বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন যে, কুর’আনের অনুসরণকারী পৃথিবীতে যেমন পথভ্রষ্ট হবে না, তেমনি আখিরাতেও সে দুর্দশাগ্রস্ত হবে না। ঐ ব্যক্তিকে যেমন ভবিষ্যতে তার জন্য কি রয়েছে তা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হতে হবে না, তেমনি অতীতে যা ঘটে গিয়েছে তা নিয়েও সে হাহুতাশ করবে না। পবিত্র কুর’আন হচ্ছে “নূর” (একটি আলো) যেমনটা আমরা আগেই বলেছি। অথচ, যে সে আলো অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয় তাকে পুরস্কৃত করা হয় “নার” (আগুন) দিয়ে।
ইবনে আব্বাস (রা.) আরো বলেন, “যে কুর’আন পড়বে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করবে, সে যে কখনোই বিপথগামী হবে না অথবা পরবর্তী জীবনে দুদর্শাগ্রস্ত হবে না সে ব্যাপারে আল্লাহ্ নিশ্চয়তা দিয়েছেন।” একথা বলে তিনি কুর’আনের নিম্নলিখিত আয়াতটি পাঠ করেন :
“…….আমার কাছ থেকে যদি তোমাদের কাছে একটি দিক নির্দেশনা আসে, তাহলে যে তা অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না অথবা দুঃখ-ভারাক্রান্ত হবে না। কিন্তু আমার বাণী থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য থাকবে এক সংকীর্ণ জীবন, এবং তাকে আমরা শেষ বিচারের দিনে অন্ধ করে পুনরুত্থিত করবো। সে বলবে, ‘হে আমার প্রভু, আমার তো পূর্বে দৃষ্টি ছিল, তাহলে আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় পুনরুত্থিত করলেন কেন?’ আল্লাহ্ বলবেন, ‘এভাবেই তুমি আমাদের আয়াতসমূহকে অবজ্ঞা করেছিলে যখন সেগুলো তোমার কাছে পৌঁছেছিল। তাই আজকের দিনে তোমাকেও অবজ্ঞা করা হবে।’ ” (সূরা তা-হা, ২০:১২৩-১২৬)
অর্থাৎ যে বিশ্বস্ততার সাথে কুর’আনের কাছে যাবে, সঠিকভাবে তা শিখবে এবং জীবনে প্রয়োগ করবে – সেই ঐ সরল পথ অনুসরণ করে যা কিনা ইহকালে ও পরকালে আল্লাহর আর্শীবাদপুষ্ট।
আল্লাহ্ আরো বলেন :
“নিশ্চয়ই এই কুর’আন যা সবচেয়ে সঠিক তার দিকেই পরিচালিত করে এবং ঐ বিশ্বাসীদের চমৎকার পুরস্কারের সুসংবাদ দেয় যারা সৎকাজ করে। আর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আমরা যে বাস্তবিকই এক কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছি, এটা তারও ঘোষণা দেয়।” (সূরা আল-ইসরা, ১৭:৯-১০)
এই কুর’আনে বিশ্বাস এবং এর অনুসরণ হচ্ছে আল্লাহর রহমতের চাবিকাঠি। আল্লাহ্ বলেন :
“এবং এটা হচ্ছে এমন একটি কিতাব, যা আমরা এক রহমত স্বরূপ তোমাদের কাছে প্রেরণ করেছি : সুতরাং এটা অনুসরণ কর ও ন্যায়পরায়ণ হও – যেন তোমরা রহমত লাভ করতে পার।” (সূরা আন্‘আম, ৬:১৫৫)
আল্লাহর রাসূল (সা.) পবিত্র কুর’আন সম্বন্ধে বলেছেন : “পবিত্র কুর’আন হচ্ছে এমন এক মধ্যস্থতাকারী যার মধ্যস্থতা গ্রহণ করা হবে এবং এমন এক সুপারিশকারী যাকে বিশ্বাস করা হবে। যে এটাকে তার সামনে রাখবে (অর্থাৎ, এর দ্বারা পরিচালিত হবে) এটা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে, এবং যে এটাকে তার পিছনে রাখবে (অর্থাৎ, এর দিক-নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করবে) এটা তাকে জাহান্নামের আগুনে নিয়ে যাবে।” (তাবারানী, বাইহাকী – আলবানীর মতে সহীহ)
আল মুনাওয়ী এই হাদীসের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, কোন ব্যক্তি যদি কুর’আনের দিক নির্দেশনা ও নীতি অনুযায়ী তার জীবনকে পরিচালনা না করে, তাহলে সে নিশ্চয়ই অন্য কোন নীতির ভিত্তিতে তার জীবন পরিচালনা করছে। আর সেজন্যই জাহান্নামের আগুন তার প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। অপরপক্ষে সে যদি কুর’আন অনুযায়ী তার জীবন পরিচালনা করে, তাহলে কুর’আনই তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।
আমরা আগে যেমন বলেছি – শেষ বিচারের দিনে পবিত্র কুর’আন হয় কারো পক্ষে অথবা, তার বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ কাজ করবে। রাসূলের (সা.) আরেকটি হাদীসে পৃথিবীর জীবনকে যে কুর’আন অনুযায়ী পরিচালিত করে, তার সাহায্যার্থে কুর’আন কিভাবে কাজ করবে তা তিনি বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন : “পুনরুত্থান দিবসে পবিত্র কুর’আনকে, যারা তা অনুযায়ী জীবন যাপন করেছে তাদের সাথে একত্রে হাজির করা হবে, যখন সূরা বাক্বারা এবং আলে ইমরান তাদের অগ্রগামী হবে।” রাসূল (সা.) তাদের তিনটি জিনিসের সাথে তুলনা করেছেন যা আমি (বর্ণনাকারী আন-নাওয়াস ইবনে সাম’আন) ভুলিনি। তিনি বলেন, “তারা হচ্ছে দুটো মেঘখণ্ডের মতো অথবা দুটো কালো সামিয়ানার মত যাদের ভিতরে আলো থাকবে, অথবা সারিবদ্ধ দুই ঝাঁক পাখির মত যারা ঐসব ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে, যারা তাদের তিলাওয়াত করেছে।” (মুসলিম)
এই প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) আরো বলেছেন : “কুর’আনের পাঠকদের বলা হবে, পাঠ কর, উন্নীত হও এবং আবৃত্তি কর যেমন তুমি পৃথিবীতে করতে, কেননা তুমি পৃথিবীতে যা আবৃত্তি করে থাকতে তার শেষ প্রান্তে তোমার অবস্থান।” (আহমাদ, তিরমিযী ও আবু দাউদে বর্ণিত – আহমাদ শাকির ও আলবানীর মতে সহীহ)
কুর’আনের সূরা আল-আন’আমের ৯২নং নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনকে ব্যাপক অর্থে আশীর্বাদপুষ্ট বলে বর্ণনা করেন। যে কায়মনে ও বিশ্বস্ততার সাথে কুর’আনের মাঝে নিহিত আশীর্বাদের সন্ধান করে, বাস্তবিকই সে এর রহমতকে, অবিচ্ছিন্ন ও উপর্যুপরি রহমত বলে অনুভব করে। তা এই জীবনে একজন ব্যক্তিকে সীরাতুল মুস্তাকিমের দিকে পরিচালনা করে তার উপর রহমত বর্ষণ করে। একজন ব্যক্তি যখন কবরেও থাকে, তখনও কুর’আন তাকে সেখানকার শাস্তি থেকে রক্ষা করে তার উপর রহমত বর্ষণ করে । আর তা কোন ব্যক্তির পরকালেও তার পক্ষে মধ্যস্থতা করে ও তার হয়ে ফরিয়াদ করে এবং তাকে শুধু এই জন্য আর্শীবাদ করে যে – সে কখনও কুর’আন পড়েছিল এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপন করেছিল।
অধ্যায়-সারাংশ
সালাহ্ আল খালিদির মতে, পবিত্র কুর’আনের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে এবং তা দ্বারা অনুপ্রাণিত করে – কুর’আনের রহমত ও পথ নির্দেশনার মাধ্যমে, আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলা একটি প্রজন্মকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। আরবরা যে সারা বিশ্বের নেতৃত্বের অবস্থানে উন্নীত হবে এবং সভ্যতার এমন এক ভিত্তিতে পরিণত হবে – শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানব সভ্যতার উপর যাদের প্রভাব দেখা যাবে – এসব কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। যে প্রজন্মকে আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনের দিক নির্দেশনার আলো দেখিয়েছিলেন, সেই প্রজন্মের নারী-পুরুষের নাম আজো সারা বিশ্বে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়ে থাকে। আজো যারা কুর’আন পড়েন, তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সেই প্রথম প্রজন্মের মত হওয়া। আখিরাতেও আল্লাহ্ কুর’আনে বর্ণিত সেই প্রথম প্রজন্মকে, তাঁর সন্তুষ্টির নিদর্শন স্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আজো যারা পবিত্র কুর’আন পড়েন, তাদেরও চিরকালীন লক্ষ্য ও আকাঙ্খা সেটাই হওয়া উচিত।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৫
পবিত্র কুর’আনের গৌণ দিকগুলোকে মুখ্য মনে করা :
বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ মুসলিম কি দৃষ্টিতে কুর’আনকে দেখে থাকেন
আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনে বলেন :
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا
“রাসূল বললেন, ‘হে আমার প্রভু, আমার জনগণ এই কুর’আনকে এক মাহজুর বস্তু (যা এড়িয়ে চলা হয় বা অবজ্ঞা করা হয়) হিসাবে গ্রহণ করেছে ।” (সূরা ফুরক্বান, ২৫:৩০)
আজকের দিনে যে কেউ যুক্তি সহকারে দেখিয়ে দিতে পারবেন যে, রাসূলের (সা.) অনেক উম্মতই পবিত্র কুর’আনকে, অবজ্ঞার বা দূরে সরিয়ে রাখার মত এক বস্তুতে পরিণত করেছে। কোন মুসলিমই জেনে বুঝে এমন একটা কাজ করতে পারে না সত্যি। কিন্তু অসচেতন ভাবে একজন মুসলিম এ ধরনের একটা গর্হিত কাজও করতে পারে – আর এখানেই নিহিত রয়েছে আজকের বিশ্বের প্রধান সমস্যার একটি।
কুর’আনকে মাহজুর হিসেবে নেবার অনেক কারণ ও পদ্ধতি থাকতে পারে। নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা কুর’আনকে এক অবহেলার বস্তুতে বা পরিহাসের বস্তুতে পরিণত করতে পারি বলে ইবনুল কাইয়্যিম মতামত ব্যক্ত করেছেন :
১। কুর’আন তিলাওয়াত না করা, এতে বিশ্বাস না করা, এর প্রতি মনোযোগ না দেওয়া অথবা এর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করা।
২। পবিত্র কুর’আন যা কিছুকে হালাল অথবা হারাম বলে ঘোষণা করে, সেসব বিধিনিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা – যদিও বা কেউ নিয়মিত কুর’আন তিলাওয়াত করে এবং সেটাতে বিশ্বাসও করে।
৩। দ্বীনের মূল ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ে পবিত্র কুর’আনকে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী হিসাবে না মানা – অথবা কুর’আনের প্রতিটি বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাসকে অপরিহার্য মনে না করা।
৪। এর অর্থ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা না করা, তা বুঝতে ব্যর্থ হওয়া এবং আল্লাহ্ কুর’আনের পাঠকের কাছ থেকে কি ধরনের কার্যকলাপ দাবী করেন তা জানতে ব্যর্থ হওয়া।
৫। অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়ে পবিত্র কুর’আনকে ব্যবহার না করে, অন্যান্য উৎসের কাছে রোগ নিরাময়ের প্রত্যাশায় ছুটে যাওয়া।
ইবনুল কাইয়্যিম যেসব বলেছেন তা ছাড়াও আরেকটি গুরুতর উপায়ে আমরা কুর’আনকে মাহজুর হিসেবে দেখে থাকি – যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা ব্যাপার, কারণ কেউ হয়তো ব্যাপারটা বুঝতেই পারবেন না অথবা স্বীকারও করতে চাইবেন না – সেটা হচ্ছে এই যে, কুর’আনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে একপাশে সরিয়ে রেখে, গৌণ ব্যাপারগুলোকে মুখ্য মনে করা এবং সেগুলোর ব্যাপারে সর্বতোভাবে মনোনিয়োগ করা বা কেবল সেগুলো নিয়েই মেতে থাকা।
মুসলিমরা অনেক কারণেই আজ কুর’আনের দ্বারস্থ হয়। আল্লাহ্ই যদিও সবচেয়ে ভাল জানেন, তবু, আজ যে বিশ্বময় মুসলিমরা কুর’আনের কাছ থেকে পরিপূর্ণ পথনির্দেশনা লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তার প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, কুর’আন যে জন্য নাযিল হয়েছিল সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে, কুর’আনের অন্যান্য আনুষঙ্গিক দিকগুলোকে এখন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এই অধ্যায়ে আমরা তাই কুর’আনের এমন কিছু গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো, যেগুলো হয়তো বৈধ এবং প্রয়োজনীয়ও – তথাপি অত্যাবশ্যকীয় দিক নয়। মুসলিমরা যদি কেবল এগুলো নিয়ে মেতে থাকে, তবে তারা কখনোই পবিত্র কুর’আনের সত্যিকার বাণীর সন্ধান পাবে না।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৬
কুর’আন তিলাওয়াত না করা
এমন অনেক মুসলিমই আছেন, যারা কুর’আনে বিশ্বাস করেন এবং জীবনে সেটাকে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেন, অথচ, তারা নিয়মিত তিলাওয়াত করতে বসেন না। সালাত আদায় করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু হয়তো তারা মুখস্থ করে থাকবেন, কিন্তু তা ছাড়িয়ে পবিত্র কুর’আন সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান আর বেশীদূর এগোয় না। দুঃখজনকভাবে, কুর’আন তিলাওয়াতের ব্যাপারে এই গা-ছাড়া ভাবটা বিরল নয়। বাস্তবে, সউদী আরবের ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি অফ স্কলারলী রিসার্চ এন্ড রিলিজিয়াস রুলিংস’ এ সংক্রান্ত ব্যাপারে নিম্নলিখিত প্রশ্ন বা এর সদৃশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন – যা থেকে আমাদের শোচনীয় অবস্থাটা সহজেই আঁচ করা যায় :
-কুর’আন তিলাওয়াত সম্বন্ধে বিধান কি?
-এটা কি অবশ্যকরণীয় না কি পছন্দনীয় একটি কাজ?
-আমরা যখন এ সম্বন্ধে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছি, তখন কেউ কেউ আমাদের উত্তর দিয়েছেন যে, এটা অবশ্যকরণীয় নয়। (অন্য কথায়) কোন ব্যক্তি যদি কুর’আন তিলাওয়াত করেন তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই, আর তিনি যদি কুর’আন তিলাওয়াত নাও করেন, তবে তার কোন গুনাহ হবে না। তাই যদি হয়ে থাকে তবে অনেকেই তা পরিত্যাগ করবে। তাহলে এটা পরিত্যাগ করার ব্যাপারে এবং তিলাওয়াত করার ব্যাপারে ফতোয়াটা আসলে কি?
আবদুল আজীজ বিন বায, আবদুর রাজ্জাক আল আফিফী, আবদুল্লাহ বিন গুদিয়ান এবং আবদুল্লাহ বিন ক্বাউদ এর সমন্বয়ে গঠিত কমিটির উত্তর ছিল নিম্নরূপ:
“কুর’আন তিলাওয়াত সম্বন্ধে আল্লাহ্ সাধারণভাবে যে আদেশ দিয়েছেন : ‘ওহীর মাধ্যমে কিতাবের যেটুকু তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে তা তিলাওয়াত কর’ (সূরা আনকাবুত, ২৯:৪৫), ‘তোমাদের প্রভুর কিতাবের যা তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে তা আবৃত্তি কর’ (সূরা কাহফ, ১৮:২৭) এবং তাঁর রাসূল (সা.) সম্বন্ধে আল্লাহর বাণী, ‘যারা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং কুর’আন তিলাওয়াত করবে, আমাকে তাদের মাঝে একজন হতে আদেশ করা হয়েছে’ (আল নামল, ২৭:৯১-৯২) – এসবের সাথে সঙ্গতি রেখে একজন মুসলিমের উচিত, তার সামর্থ অনুযায়ী কুর’আন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা এবং যত ঘন ঘন সম্ভব তাতে আত্মনিয়োগ করা। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ সম্বন্ধে আরো বলেছেন, ‘কুর’আন তিলাওয়াত কর, কেননা পুনরুত্থান দিবসে তা তার সঙ্গীদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দাঁড়াবে’ (সহীহ মুসলিম)। একজন মুসলিম যে সব বিবিধ উপায়ে কুর’আন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে ওলামারা চিহ্নিত করেছেন, তার যে কোনটির মাধ্যমেই কুর’আন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা, সে সব সময় এড়িয়ে চলবে। [উত্তরের এই পর্যায়ে এসে তাঁরা পূর্বে উল্লিখিত সূরা আল ফুরক্বানের ৩০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা ও ‘মাহজুর’ শব্দের অর্থ সংক্রান্ত বর্ণনা ইবনে কাসীরের তাফসীর থেকে তুলে দিয়েছেন]।”
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, যে ব্যক্তি কুর’আন পড়ে অথচ তা প্রয়োগ করে না, তার চেয়ে ঐ ব্যক্তি যে কুর’আনে বিশ্বাস করে এবং যখনই তাকে কুর’আনে কি আছে তা মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তখনই সে তা প্রয়োগ করে, তার অবস্থাটা উন্নততর। আসলে তার অবস্থা, যে গোটা কুর’আন মুখস্থ করে রেখেছে অথচ তা প্রয়োগ করে না – তার চেয়েও ভাল। তথাপি, তার ঈমানের উপর এবং তার জীবনের উপর পবিত্র কুর’আনের যে বিশাল সুফল থাকতে পারতো, তা থেকে হয়তো সে বঞ্চিত হয়ে চলেছে। প্রতিনিয়ত কুর’আন তিলাওয়াত করে, এমনকি একই সূরাগুলি বার বার পড়েও কেউ হয়তো এমন জ্ঞান লাভ করবে -অথবা- তার অন্তর্চক্ষু এমনভাবে খুলে যাবে, যা হয়তো এমনি এমনি হতো না। সুতরাং, যারা কুর’আনে বিশ্বাস করেন এবং তা জীবনে প্রয়োগও করেন – অথচ, একটু সময় নিয়ে কুর’আন তিলাওয়াত করেন না, তারা সম্ভবত কুর’আনের বৃহত্তর সুফল লাভ করা থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করছেন। এরকম ব্যক্তিদের কুর’আনের কাছে প্রত্যাবর্তন করা উচিত এবং তা সঠিকভাবে পড়া উচিত। তাদের উচিত নিজেদের উপর কুর’আনের পরিপূর্ণ প্রভাব পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা ও সেইসঙ্গে কুর’আনের পথ নির্দেশনাকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণে লাভ করার চেষ্টা করা।
উপরন্তু, যিনি নিয়মিত কুর’আন অধ্যয়ন করেন না, তার জন্য কুর’আনের কোন কোন শিক্ষা ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অথবা এমনও হতে পারে যে, তিনি নিয়মিত ভাবে কুর’আনের যে সমস্ত শিক্ষা প্রয়োগ করেন, সেগুলো তার মনে থাকে – কিন্তু যেগুলো কদাচিৎ বা বিশেষ কোন উপলক্ষে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলোকে তিনি ভুলে যান। রাসূল (সা.) বলেছেন : “কুর’আনের প্রতি মনোযোগী হও (এবং এর সম্বন্ধে তোমাদের মনকে তাজা রাখ), কেননা যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তাঁর শপথ, (কারো স্মৃতি থেকে) এর হারিয়ে যাওয়া, বেঁধে রাখা একটা উট পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে অধিকতর সম্ভাব্য।” (মুসলিম)। এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে সালিহ্ আল ফাওযান, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একজন মুসলিমের উচিত মাসে অন্তত একবার গোটা কুর’আন তিলাওয়াত করা। আল্লাহ্ই সবচেয়ে ভাল জানেন!
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৭
পবিত্র কুর’আনের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করার পূর্ণ সদিচ্ছা ছাড়াই, কেবল বরকতের জন্য কুর’আন তিলাওয়াত করা বা কাছে রাখা।
একজন ব্যক্তি, যিনি কুর’আন তিলাওয়াত করেন – তার উপর যে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে পারে তা নিয়ে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ যদি কেউ মুসলিম বিশ্বের দিকে একটু মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে দেখে, তবে দেখতে পাবে যে, লোকেরা আজ মসজিদে কুর’আন তিলাওয়াত করছে, কুর’আন পড়ে সভা ও সমাবেশ শুরু করছে, কুর’আন তিলাওয়াত দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু করছে, রেডিও বা টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু ও শেষ হচ্ছে কুর’আন তিলাওয়াত দিয়ে অথবা কেউ মৃত্যুবরণ করলেও তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে কুর’আন পড়া হচ্ছে। এসব দেখে কারো ধারণা জন্মাতে পারে যে, আজকালকার মুসলিমরা প্রধানত একটি উদ্দেশ্যেই কুর’আনের শরণাপন্ন হয় – পবিত্র কুর’আন থেকে বরকত লাভ করতে। [কুর’আন তিলাওয়াত করলে কারো উপর যে বরকত নেমে আসতে পারে, আমরা সেটায় মোটেও সন্দেহ পোষণ করছি না। বরং নীচে আমরা একটি হাদীস তুলে দিচ্ছি যাতে রাসূল (সা.) এই বরকত নাযিল হবার কথা বলেছেন :
“তোমাদের মাঝে কারা প্রতিদিন সকালে বুসান বা আল আকিক-এ যেতে চাও (এগুলো হচ্ছে মদীনার বাইরে দুটি স্থান যেখানে উটের বাজার বসতো) এবং কোন পাপ ছাড়া অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই দুটো উট সঙ্গে করে নিয়ে ফিরে আসতে চাও?” আমরা (সাহাবীরা) বললাম, “আমরা সেটা করতে খুবই পছন্দ করবো।” তিনি তখন বললেন, “তোমরা কি মসজিদে যাও না এবং সেখানে মহিমময় ও গৌরবান্বিত আল্লাহর কিতাব থেকে দুইটি আয়াত পড় না বা শিক্ষা দাও না, আর সেটা একজন ব্যক্তির জন্য দুটো উটের চাইতে শ্রেয়। আর তিনটি (আয়াত) তার জন্য তিনটির (উট) চেয়ে শ্রেয় এবং চারটি চারটির চেয়ে শ্রেয় ..এরকম।”(মুসলিম)]
“উসায়েদ ইবনে হুদায়ের বলেনযে, একরাতে তিনি তাঁর ঘোড়াকে পাশে বেঁধে রেখে কুর’আন তিলাওয়াত করছিলেন। ঘোড়াটি অস্থির হয়ে উঠলে তিনি কুর’আন তিলাওয়াত বন্ধ করে দেন এবং সাথে সাথে ঘোড়াটিও স্থির হয়ে গেল। তিনি পুনরায় কুর’আন পড়তে শুরু করলেন এবং ঘোড়াটি আবারও লাফিয়ে উঠল। তিনি কুর’আন পড়া বন্ধ করলে ঘোড়াটি সুস্থির হয়ে গেল। এরপর তিনি যখন আবারো পড়তে শুরু করলেন, ঘোড়াটি তখন আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো এবং তিনি কুর’আন তিলাওয়াত বন্ধ করলে সে পুনরায় শান্ত হলো। তিনি তখন সেই স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, কেননা তাঁর ছেলে ইয়াহিয়া তাঁর সাথে ছিল এবং তিনি ভয় পেলেন যে, তার কোন ক্ষতি হতে পারে। তিনি যখন তাঁর ছেলেকে সরিয়ে ফেললেন এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তখন আকাশ দেখতে পেলেন না। পরদিন সকালে তিনি রাসূলকে (সা.) কি ঘটেছিল তা বর্ণনা করলেন। রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন, ‘হে ইবনে হুদায়ের আবৃত্তি কর, হে ইবনে হুদায়ের আবৃত্তি কর।’ ইবনে হুদায়ের উত্তর দিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি ইয়াহিয়াকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম যেহেতু ঘোড়াটি তার কাছাকাছি ছিল, সুতরাং আমি (পড়া থেকে) মাথা উঠালাম এবং তার কাছে গেলাম। আমি যখন মাথা তুললাম এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তখন এক খণ্ড মেঘ দেখলাম যার মাঝে প্রদীপের মত বস্তু রয়েছে। তখন আমি ঐ দৃশ্য যাতে দেখতে না হয় সেজন্য সেখান থেকে সরে গেলাম। রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন, ‘তুমি কি জান তা কি ছিল?’ ইবনে হুদায়ের উত্তর দিলেন, ‘না।’ তিনি তাঁকে বললেন, ‘ওগুলো ছিল তোমার কণ্ঠস্বর শুনে কাছে আসা ফেরেশতাগণ। তুমি যদি সকাল পর্যন্ত তিলাওয়াত করতে থাকতে, তবে লোকজন এসে দৃশ্যটা দেখতো এবং তারা তখনও অদৃশ্য হতো না।’ ” (বুখারী ও মুসলিম)।
ইবনে হুদায়েরের অভিজ্ঞতার মতই আল বারারও একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আল বারার বেলায় রাসূল (সা.) তাঁকে বলেছিলেন যে, যে মেঘখণ্ডকে দেখে তাঁর ঘোড়া ভয় পাচ্ছিল, তা আসলে ছিল প্রশান্তি, যা কুর’আন তিলাওয়াতের কারণে নেমে এসেছিল। (মুসলিম)।
এছাড়াও কুর’আন তিলাওয়াতের জন্য এক বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, “যে আল্লাহ্র কিতাবের একটি হরফ (একটি শব্দ বা একটি অক্ষর) পাঠ করে, তার হিসাবে একটি সৎকর্ম লেখা হবে এবং প্রতিটি সৎকর্মের জন্য সে দশগুণ পুরস্কার লাভ করবে। আমি বলছি না আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।” (তিরমিযী ও অন্যান্য কিতাবে উল্লিখিত, আলবানীর মতে সহীহ)।
পবিত্র কুর’আন তিলাওয়াত করার, এটা যে একটা বাস্তব প্রতিফল সে ব্যাপারে কেউ সন্দেহ পোষণ করতে পারে না এবং প্রতিটি মুসলিমের সে বিশ্বাস থাকা উচিত। কিন্তু মনে করুন কেউ কেবল এই বরকতটুকু লাভ করার জন্যই কুর’আন তিলাওয়াত করে থাকেন, অর্থাৎ তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতি অক্ষর পড়ার জন্য দশটি নেকী লাভ করা অথবা তিনি তার উপর প্রশান্তি নেমে আসবে বলে আশা করে কুর’আন তিলাওয়াত করেন – তিনি বাহ্যিক তিলাওয়াতের সীমা পেরিয়ে আর সামনে এগোন না এবং কুর’আনে আল্লাহ্ তার কাছে কি চাইছেন, তাও বোঝার চেষ্টা করেন না। এরকম একজন ব্যক্তি কি সঠিক পন্থায় কুর’আন অধ্যয়ন করছেন? তিনি কি পবিত্র কুর’আনের সত্যিকার উদ্দেশ্যটা বুঝলেন? একজন ব্যক্তি যিনি এরকমভাবে কুর’আন পড়েন, ইমাম আল-গাজ্জালীর মতে, তিনি তখন তার পড়া থেকে তার জিহ্বার নড়াচড়া ছাড়া আর কিছুই লাভ করেন না। উদাহরণ স্বরূপ একজন মানুষ কিভাবে আল্লাহ্কে অমান্য করার ক্ষতি সংক্রান্ত আয়াতগুলো পড়বেন অথচ তার হৃদয়ে ভয়ের কোন সঞ্চার হবে না? একজন মানুষ যদি এভাবে কুর’আন পড়েন, তাহলে সত্যিকার অর্থে তিনি যে ‘পড়লেন’ – সেটাই বলা যাবে না, ঠিক যেমন কেউ যদি কোন একটি সংকেত পড়ে (যেমন রোড সিগন্যাল) অথচ, সে যদি না বোঝে যে ঐ সংকেত কি বোঝাতে চাচ্ছে, আর তাই তা অমান্য করে – তাহলে সে ক্ষেত্রে বলতে হবে যে, আসলে সে সংকেতটি পড়েইনি।
সাহাবী আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, “সম্ভবত একজন পবিত্র কুর’আন পড়ছে এবং কুর’আন তাকে অভিশাপ দিচ্ছে।” অন্য কথায় সেই ব্যক্তি, নীচে যেমন বর্ণিত রয়েছে তেমনিভাবে আল্লাহর কালাম পাঠ করছে :
“………নিশ্চয়ই জুলুমকারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়।” (সূরা হুদ, ১১:১৮)
অর্থাৎ সে যা পড়ছে তা প্রয়োগ না করে সে নিজেই এই আয়াতে বর্ণিত একজন জুলুমকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করছে।
বাস্তবিকই, যারা কেবল তাদের জিহ্বা দ্বারা এইজন্য কুর’আন উচ্চারণ করে যে, সেই পাঠের জন্য তাদের উপর বরকত নেমে আসবে – অথচ, কখনই কুর’আন বোঝার জন্য ও সেটাকে জীবনে প্রয়োগ করার জন্য কোন সময়ক্ষেপণ করে না, তাদের অবস্থা অনেকটা আরেকটি জনগোষ্ঠীর মত যাদের কথা আল্লাহ্ কুর’আনে বর্ণনা করেছেন :
“যাদের উপর তাওরাতের ভার অর্পণ করা হয়েছিল, এবং যারা তার ব্যাপারে (তাদের করণীয় পালন করতে) ব্যর্থ হয়েছে তাদের উপমা হচ্ছে ঐ গাধার মত যে বইপত্রের বিশাল বোঝা বহন করে, অথচ সেগুলো বুঝতে অক্ষম। …”
(সূরা জুমু‘আ, ৬২:৫)
আবদুল গণির মতে কেবল পড়েই যারা পরিতৃপ্ত হন, সেইসব পাঠকদের অবস্থা নিম্নলিখিত আয়াতেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
“হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কার্যে পরিণত কর না? আল্লাহ্র দৃষ্টিতে এটা একটা গর্হিত অপরাধ যে, তোমরা এমন কিছু বল যা তোমরা কর না।” (সূরা সাফ, ৬১:২-৩)
ঐ সমস্ত মুসলিমগণ যাঁরা বলেছিলেন যে, তাঁরা এমন কাজ করতে চান যা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, আর তারপরে যখন জিহাদের আদেশ নাযিল হয়েছিল, তখন তাঁরা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কর্মটি করতে যখন অসুবিধা বোধ করছিলেন – তখন তাদের দোষারোপ করে উপরোক্ত আয়াতগুলি নাযিল হয়। এখানে এসে আবদুল গণি প্রশ্ন রাখেন, “যে ব্যক্তি কুর’আন পড়ে, অথচ যে এর শিক্ষা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে – এর আদেশসমূহ পালন করে না এবং কুর’আন যে বিধান উপস্থাপন করে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখে – তার অবস্থাটা তাহলে কি দাঁড়ায়? তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, কেননা সে দাবী করে যে, সে কুর’আন বিশ্বাস করে, সে কুর’আন পড়ে, কুর’আন কি বলছে তা সে নিজে উচ্চারণ করে অথচ তার উপর সেটার কোন ধরনের প্রভাব পড়ে না।”
সত্যি বলতে কি, আজকাল কিছু মুসলিম বছরের পর বছর ধরে কেবল কুর’আন পড়েই আত্মতৃপ্তি লাভ করছেন – তারা যা পড়লেন, তা জীবনে সঠিকভাবে প্রয়োগ করলেন কিনা – সেটা নিশ্চিত করতে যা পড়লেন, তা বোঝার জন্য কোন সময় ব্যয় করছেন না। এটা সেইসব সাহাবীদের পন্থার সম্পূর্ণ বিপরীত, যাঁরা কুর’আনের পথনির্দেশনা অনুসরণ করেছিলেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন:“আমাদের মাঝে কেউ যখন দশটি আয়াত শিখতেন, তখন তিনি সেগুলোর অর্থ না বোঝা পর্যন্ত এবং সে অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করতে না পারা পর্যন্ত আর সামনে এগুতেন না [অর্থাৎ নতুন কোন আয়াত পড়তে যেতেন না]।” একই ভাবে আবু আবদুর রহমান আল সুলাইমী বলেন, “আমাদেরকে যাঁরা কুর’আন পড়ে শোনাতেন, তাঁরা আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা রাসূলের (সা.) কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং তাঁরা যদি দশটি আয়াতও শিখতেন, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা ঐ আয়াতগুলোর ভিতর কি কি করণীয় রয়েছে, তা না জানতেন, ততক্ষণ তাঁরা সেগুলো ত্যাগ করতেন না (অর্থাৎ সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে নতুন কিছু শিখতে যেতেন না)। সুতরাং তাঁরা কুর’আন এবং তার প্রয়োগ একই সাথে শিখেছিলেন।” আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, “[ঈমান লাভের পূর্বে] আমরা অনেকদিন জীবন যাপন করেছিলাম এবং কুর’আনের অনেকাংশ নাযিল হওয়ার আগেই আমাদের ঈমান নসীব হয়েছিল। তারপর যখন মুহাম্মাদের (সা.) কাছে একটি সূরা নাযিল হতো, তিনি তার হারাম ও হালাল বিধানগুলো এবং তার আদেশ ও নিষেধ ও সেই আয়াতের প্রতি তাঁর করণীয় কি তা জেনে নিতেন। তারপর একটা সময় এলো, যখন আমি দেখলাম যে কাউকে ঈমান লাভের পূর্বেই পবিত্র কুর’আন দেওয়া হলো ; সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা কুর’আন, তার আদেশ-নিষেধ কি কি তা অনুধাবন করা ছাড়াই অথবা কুর’আনের প্রতি তার কি মনোভাব থাকা উচিত তা বোঝা ছাড়াই পড়ে শেষ করলো এবং উড়ে চলে যাওয়া কোন প্রাণীর মত সে যেন চারিদিকে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল।” (আল বাইহাকী ও আল হাকিম)।
সেইসব মানুষ যারা এরকম করে কুর’আন পড়ে তারা আসলে কুর’আন পড়ার সত্যিকার পূর্বশর্ত পালন করছে না; ত্রুটিযুক্ত পদ্ধতিতে কুর’আন পড়ার পরেও এ থেকে বরকত লাভ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে তাই সন্দেহের অবকাশ থাকে। আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনে বলেন:
“যাদের কাছে আমরা কিতাবখানি দিয়েছি, তারা তা এমন ভাবে তিলাওয়াত করে যেমন তিলাওয়াত করা উচিত। তারাই হচ্ছে ঐ সমস্ত ব্যক্তি যারা সেটাতে বিশ্বাস করে, আর যে কেউ এতে অবিশ্বাস করে তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা বাক্বারা, ২:১২১)
যেমনভাবে তিলাওয়াত করা উচিত এ কথার ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, “যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, সঠিক তিলাওয়াত করা হচ্ছে যা কিছুকে এটা বৈধ বলে ঘোষণা করে – সেটাকে বৈধ মনে করা, যা কিছুকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে – সেটাকে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা, আল্লাহ্ যেভাবে নাযিল করেছেন – সেভাবে একে আবৃত্তি করা, সঠিক অর্থ থেকে কোন শব্দকে বিচ্যুত করে বিকৃত অর্থ না দেয়া, এবং এমনভাবে ব্যাখ্যা না করা যেভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করা অনুচিত।”
এ ছাড়াও রাসূলের (সা.) অনেক হাদীস – যেখানে তিনি কুর’আন তিলাওয়াতকারীর প্রাপ্য সুফল বর্ণনা করেছেন – সেখানে তিনি সুফল লাভের শর্ত হিসেবে ঐ ব্যক্তির কথা বলেছেন: “যে কুর’আন তিলাওয়াত করে এবং সে অনুযায়ী কাজও করে”। উদাহরণস্বরূপ একটা হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন যে, সূরাগুলো মানুষের পক্ষে হয়ে সুপারিশ করবে, যা আমরা ইতিপূর্বেও উল্লেখ করেছি:
“পুনরুত্থান দিবসে পবিত্র কুর’আনকে, যারা তা অনুযায়ী জীবনে যাপন করেছে তাদের সাথে একত্রে হাজির করা হবে, যখন সূরা বাক্বারা এবং আলে ইমরান তাদের অগ্রগামী হবে……..।” (মুসলিম)
বা ঐ হাদীসটি যেখানে রাসূল (সা.) বলেন :
“একজন বিশ্বাসী যে কুর’আন তিলাওয়াত করে ও সেই অনুযায়ী কাজ করে তার উদাহরণ হচ্ছে ঐ কমলালেবু …………..।”(বুখারী)
উপরে উদ্ধৃত দুটো হাদীসেই রাসূল (সা.) যে অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপারটি উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে: ‘কুর’আন অনুযায়ী কাজ করা বা জীবনে কুর’আনকে প্রয়োগ করা’। সত্যিকার বরকত এবং গুণাগুণ তার মাঝেই দেখতে পাওয়া যায় যে কুর’আন অনুযায়ী জীবন যাপন করে – তার মাঝে নয়, সে কেবল পড়ার জন্য কুর’আন পড়ে যায় – অথচ সে যা পড়ল তা জীবনে প্রয়োগ করে না।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৮
কুর’আনকে কেবলি শিফা হিসাবে অথবা শারীরিক অসুখ সারাতে ব্যবহার করা
আল-কুর’আনে এমন কতিপয় আয়াত রয়েছে, যেগুলোকে একথার প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হয় যে, শারীরিক অসুস্থতার প্রতিষেধক হিসাবে কুর’আনকে ব্যবহার করা যায়। ঐ সব আয়াতের একটি হচ্ছে :
“আমরা ধাপে ধাপে কুর’আনের অংশ নাযিল করেছি যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও রহমত। জুলুমকারীদের জন্য তা কেবলমাত্র তির পর তি।” (সূরা ইসরা, ১৭:৮২)
“…. বল : যারা বিশ্বাস করে এটা তাদের জন্য এক পথ নির্দেশক এবং শিফা।….” (সূরা ফুস্সিলাত, ৪১:৪৪)
এসব আয়াতে শারীরিক রোগের আরোগ্যের কথা বলা হয়েছে, নাকি আধ্যাত্মিক রোগমুক্তির কথা বলা হয়েছে তা নিয়ে কিছু আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
যাহোক, কুর’আন যে শারীরিক ও আত্মিক দুই ধরনের রোগের বেলায়ই শিফা, তা নিম্নলিখিত হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলের (সা.) কিছু সাহাবী এমন এক আরব গোত্রের সদস্য ছিলেন, যারা তাঁদের প্রতি অতিথিপরায়ণ হতে নারাজ ছিলেন। তাঁরা যখন সেই গোত্রের মাঝে অবস্থান করছিলেন, তখন সেই গোত্রের প্রধানকে সাপে কামড়েছিল (অথবা বৃশ্চিক দংশন করেছিল) এবং তারা সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাদের সাথে কি কোন ওষুধ আছে? অথবা তোমাদের সাথে এমন কেউ আছে যে ঝাড়-ফুঁক করতে পারে?” তাঁরা উত্তর দিলেন, “তোমরা আমাদের প্রতি অতিথিপরায়ণ হতে নারাজ ছিলে, তাই তোমরা অর্থপ্রদান না করলে আমরা তার চিকিৎসা করবো না।” তারা একপাল ভেড়া দিতে সম্মত হলো। একজন সাহাবী সূরা ফাতিহা পড়তে শুরু করলেন এবং তাঁর লালা জড়ো করে তিনি ঐ ব্যক্তির ক্ষতস্থানে লাগালেন। ঐ গোত্রপ্রধান ভাল হয়ে উঠলো এবং তার লোকেরা সাহাবীদের ভেড়ার পাল দিতে চাইলে তাঁরা বলেন, “আমরা নবীকে (সা.) জিজ্ঞেস না করে এটা গ্রহণ করবো না (আমাদের জন্য এটা বৈধ কিনা সেটা না জেনে)।” তাঁরা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন, তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন, “তোমরা কি করে জানলে যে সূরা ফাতিহা দিয়ে ঝাড় ফুঁক করা যায়? ওটা (ভেড়ার পাল) নাও এবং আমার জন্য এক অংশ বরাদ্দ করো।” (বুখারী)।
কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, একমাত্র এই কারণেই যদি কেউ কুর’আনকে ব্যবহার করে বা এর কাছে যায়, তাহলে সে কুর’আনের বৃহত্তর কার্যকারিতা থেকে বঞ্চিত হলো। সেক্ষেত্রে সে শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার মত একটি কারণে কুর’আনকে ব্যবহার করবে – যা করা এমনিতে বৈধ – কিন্তু সে তার মঙ্গলের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অসুস্থতার চিকিৎসার কাজে কুর’আনকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলো। আল্লাহ্ বলেছেন :
“হে মানবকুল! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে এক সতর্কবাণী ও তোমাদের অন্তরের অসুস্থতার নিরাময় এসেছে, আর যারা বিশ্বাস করে তাদের জন্য এটা হচ্ছে এক পথনির্দেশনা ও রহমত।” (সূরা ইউনুস, ১০:৫৭)
উপরের এই আয়াতের উপর মতামত দিতে গিয়ে ইবনে বাদীস লেখেন :
“সূরা ইউনুসের এই আয়াতে কুর’আনকে অন্তরের চিকিৎসা বলে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে – অন্তর হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে বিশ্বাস সংরক্ষিত হয়। কেননা সেটাই হচ্ছে কুর’আনের প্রধান লক্ষ্য এবং সেটাই হচ্ছে অন্যান্য দিকগুলোর ভিত্তি। এটা এজন্য যে, যদি খারাপ বিশ্বাস ও সন্দেহগুলোকে অন্তর থেকে দূর করা যায় এবং সত্যে বিশ্বাস স্থাপন করা হয় ও নিশ্চয়তা ধরে রাখা হয়, তখন আত্মা পরিশুদ্ধ হয়ে যায় – ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সামাজিক পর্যায়ে মানুষের ব্যবহার শুদ্ধ হয়ে যায় এবং তারা তখন পূর্ণতার দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। (উপরে উদ্ধৃত) সূরা আল-ইসরা ও সূরা ফুসসিলাতের আয়াতসমূহে যেমন ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কুর’আন দুষ্ট চরিত্রের জন্যও এক চিকিৎসা – তার সাথে এর (উপরোক্ত বক্তব্যের) কোন বিরোধ নেই। কেননা, চরিত্রের উৎস হচ্ছে বিশ্বাস – আর তাই, চরিত্র হচ্ছে বিশ্বাসের স্বাভাবিক পরিণতি। উপরন্তু, মানুষের আত্মা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না, যতক্ষণ না (বিশ্বাস ও চরিত্র) উভয়ে সুস্থ না হয়। এ ব্যাপারটারও আবার এই বাস্তবতার সাথে কোন বিরোধ নেই যে, কোন কোন ক্ষেত্রে কুর’আন শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার কাজেও লাগতে পারে। যেমন সাধারণভাবে চিকিৎসা বা নিরাময়ের কথা বলা হলে, তার আওতায় এ দিকটাও এসে যাবে….. কিন্তু, কুর’আনে শিফা বলতে যা বোঝানো হয় তার মূল উদ্দেশ্য সেটা নয়।”
এরপর ইবনে বাদীস ব্যাখ্যা করে যান যে, অসুস্থতা হয় শারীরিক – নতুবা আধ্যাত্মিক। আধ্যাত্মিক রোগ হচ্ছে সেগুলো, যেগুলো মনের বা আত্মার রোগ। মনের সাথে সম্পর্কযুক্ত রোগগুলোর মাঝে রয়েছে ঔদাসীন্য, ভুল ধারণা, সভ্যতার ও পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুকরণ, মিথ্যা বিশ্বাস এবং সত্য সম্পর্কে সন্দেহ। আত্মার সাথে সম্পর্কযুক্ত রোগগুলোর মাঝে রয়েছে চারিত্রিক দুর্বলতা, লালসা এবং অসদিচ্ছা।
উভয় ধরনের আধ্যাত্মিক রোগের নিরাময় পবিত্র কুর’আনে রয়েছে। প্রথম প্রকারের রোগের ব্যাপারে কুর’আন মানবকুলকে চিন্তা করতে, ভেবে দেখতে, বুঝতে এবং নিজেদের ও প্রতিবেশের সৃষ্টিসমূহের তদন্ত করে দেখতে আহ্বান জানায়। কুর’আন মানবকুলকে শিক্ষা দেয়, কি করে এই সৃষ্টির বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে হবে এবং কি করে চিন্তা করতে হবে। পূর্বপুরুষরা ভ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও যারা তাদের পূর্বপুরুষের শিক্ষাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, কুর’আন তাদের দোষারোপ করে। এরপরে কুর’আন এই বিশ্বের বাস্তবতার ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রশ্নাতীত যুক্তি উপস্থাপন করে। যারা এ ধরনের অসুস্থতা থেকে নিরাময় লাভ করতে চান, তাদের জন্য ফলাফল দাঁড়াবে সন্দেহ অথবা সংশয়মুক্ত সত্যের উপর এক দৃঢ় বিশ্বাস। দ্বিতীয় ধরনের আধ্যাত্মিক রোগের উপরে বলতে গেলে (অর্থাৎ আত্মার রোগের ব্যাপারে বলতে গেলে) বলতে হয় যে, কুর’আন একজন মানুষকে এই ধরনের রোগের দুষ্ট পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। একই সময়ে তা কাউকে সঠিক আচরণ ও চরিত্রের বিরাট সুফল ও গুরুত্ব বর্ণনা করে সেগুলোর দিকে পরিচালিত করে।
এভাবেই উভয় শ্রেণীর আধ্যাত্মিক রোগের নিরাময় ঘটে। যদিও দুটো রোগেরই নিরাময় ঘটে বিশ্বাস সঠিক করার মধ্য দিয়ে – আর সঠিক বিশ্বাসই অন্যান্য সৎকর্মের ভিত্তি। সত্যি বলতে কি ঐ ধরনের রোগের (আধ্যাত্মিক রোগ) সত্যিকার নিরাময় কেবলমাত্র পবিত্র কুর’আনেই পাওয়া যাবে। কেউ যদি অন্য কোন উৎসের কাছে এসবের নিরাময় খোঁজ করে, তবে তার রোগ কেবল বৃদ্ধিই পাবে। আজকের পৃথিবীতে ঠিক তেমনটিই ঘটছে, যখন মানুষ মানুষের তৈরি তত্ত্ব ও নীতিমালার কাছে নিজেদের সমস্যার সমাধান ও রোগের নিরাময়ের জন্য ছুটে যায় – অথচ, কেবলমাত্র তার সৃষ্টিকর্তাই এক সত্যিকার ও পরিপূর্ণ সমাধান দিতে সক্ষম। তাই যে কোন বিশ্বাসীর উচিত, ইসলাম সম্বন্ধে যে কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সকল “ইজম” বা মতবাদ ত্যাগ করে, ইখলাস বা বিশ্বস্ততার সাথে কেবল মাত্র আল্লাহর কালাম ও রাসূলের (সহীহ্) হাদীসের শরণাপন্ন হওয়া।
কুর’আন কিভাবে পড়বো ও বুঝবো – ১৯
‘বৈজ্ঞানিক বিস্ময়’ সনাক্ত করার জন্য কুর’আন পড়া
অতিসম্প্রতি, বিশেষত বর্তমান হিজরীর শুরু থেকে কুর’আনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময় এক বহুল আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে যা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় মুসলিম বিশ্ব যে অনেক পিছিয়ে পড়েছে, এই সত্য উপলব্ধি করে সম্ভবত হীনমন্যতাবশতই, এই হিজরী শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও লেখকই এই কথাটা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, পশ্চিমা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কুর’আনের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উভয়ের কোন বিরোধই নেই। কুর’আনের ব্যাখ্যা বা তাফসীর লিখতে গিয়ে বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা এ যুগেই যে প্রথমবারের মত করা হলো তা নয়। বিজ্ঞানের ভিত্তিতে যারা কুর’আন ব্যখ্যা করতে চেয়েছেন, তাদের মাঝে আবু হামিদ মুহম্মাদ আল গাজ্জালীকেই প্রথম বলে বিবেচনা করা হয় – যদিও বিজ্ঞানের সাহায্যে কুর’আনের ব্যাখ্যা দিতে চাওয়া পুরানো ও আধুনিক স্কলারদের ভিতর দৃষ্টিভঙ্গীর উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। সাধারণত, আগের স্কলাররা কুর’আনকেই তাদের বিশ্বাস ও জ্ঞানের ভিত্তি বলে গ্রহণ করতেন এবং তাদের সমকালীন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কোনগুলি কুর’আনকে সমর্থন করে সেটা হয়তো উল্লেখ করতেন। পক্ষান্তরে আধুনিক যুগের অনেক লেখক বা স্কলাররাই বিজ্ঞানকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এবং কুর’আনকে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যা এসকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সমর্থন করবে – যদিও বাস্তবে সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো মোটেই ঐসব থিওরীর প্রতি ইঙ্গিত করেনি।
যাহোক্, কুর’আন নিজেই যে এক অলৌকিক বিস্ময় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কুর’আনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময়সমূহকে সঠিকভাবেই কুর’আনের অলৌকিক প্রকৃতির একটা দিক বলে ধরা যেতে পারে। এই বিস্ময়কর দিকটা কিছু মানুষকে এ ব্যাপারে আরো নিশ্চিত বিশ্বাস দান করেছে যে, কুর’আন আসলেই সত্য। অমুসলিমদের ইসলামের পথে ডাকার জন্য এ ব্যাপারটাকে একটা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
কুর’আনের অলৌকিক প্রকৃতি যা রাসূলের (সা.) সত্যবাদিতা প্রমাণ করে, সেটাকে কুর’আনের প্রধান উদ্দেশ্যসমূহের একটি বলে বর্ণনা করেছেন কুর’আনের বিখ্যাত তাফসীরকার ইবনে আশুর। আল্লাহ্ মানবজাতিকে কুর’আনের সদৃশ কিছু উপস্থাপন করতে চ্যালেঞ্জ করেন। সুতরাং কুর’আনের কোন তাফসীরকারের কার্যবিধির একটা অংশ হচ্ছে কুর’আনের অলৌকিক প্রকৃতিকে প্রস্ফুটিত করে তোলা। কিন্তু তিনিও মনে করেন যে, কুর’আনের ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’কে ন্যূনতম পর্যায়ে সংযত রাখা উচিত এবং সেগুলো যেন কুর’আন শিক্ষার এক মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে না দাঁড়ায়।’ আমরা এখানে ঠিক একথাটাই জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছি:
বৈজ্ঞানিক বিস্ময়সমূহ সনাক্তকরণ এবং বিস্তারিতভাবে সেগুলোর গভীরে প্রবেশ করে সেগুলো অধ্যয়ন কুর’আন শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। আসলে কুর’আনের সত্যিকার দিকনির্দেশনা লাভের জন্য কুর’আনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময়সমূহ সনাক্তকরণ আবশ্যক নয়। এজন্যই রাসূলের (সা.) সাহাবীগণ, যাঁরা সঠিকভাবে কুর’আনকে প্রয়োগ করার ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রগামী, তাঁরা কুর’আনের এই দিকটি নিয়ে তেমন একটা ভাবেননি, তথাপি তাঁরা কুর’আন বুঝেছিলেন এবং কি করে তা প্রয়োগ করতে হবে তাও জেনেছিলেন।
একজন পাঠক, যিনি কেবল বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা খুঁজতেই ব্যস্ত, তার জন্য এদিকটায় অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ বিপদ বয়ে আনতে পারে। কেননা, তিনি যে আয়াতটি পড়ছেন, সে আয়াতটির অন্তর্নিহিত মর্মকথাটি হয়তো তিনি বুঝতে ব্যর্থ হবেন। তিনি হয়তো কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ের গবেষণায় জড়িয়ে পড়বেন – যেগুলো তার দিকনির্দেশনা লাভের জন্য মোটেই আবশ্যক নয় – অথচ, তা করতে গিয়ে, ঐ আয়াত যে বৃহত্তর দৃশ্যপট বর্ণনা করছে, সেটা হয়তো তার চোখ এড়িয়ে যাবে। নিম্নলিখিত আয়াতটি হচ্ছে এধরনের সম্ভাবনার এক উত্তম উদাহরণ :
“তুমি কি দেখনি তোমার প্রভু কিভাবে ছায়া ছড়িয়ে দেন? তিনি চাইলে সেগুলোকে স্থির রাখতে পারতেন। কিন্তু আমরা সূর্যকে এর নির্দেশক বানিয়ে দিয়েছি। তারপর আমরা এটাকে নিজেদের কাছে প্রত্যাহার করে নিই, এক ধীর ও গোপন প্রত্যাহার।” (সূরা ফুরক্বান, ২৫:৪৫-৪৬)
এই পর্যায়ে যে কেউ এই আয়াতের কথাগুলো বিশ্লেষণ করতে শুরু করতে পারে এবং সেগুলোর সাথে ছায়াসমূহের প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা ছায়াসমূহের সাথে সূর্যের সম্পর্কের বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা বের করার চেষ্টা করতে পারে। এই ধরনের আয়াতের সম্ভাব্য প্রধান উদ্দেশ্য কি – সে বিষয়ে মুহাম্মাদ কুতুব এক দৃষ্টি উন্মোচনকারী আলোচনা করেছেন।
কুতুব লিখেছেন যে, এই আয়াতের শব্দগুলিতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কোন নতুন বা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার যে রয়েছে এমন কোন কথা নেই। তবু, এই আয়াত পড়ার পরে কেউ, যে দৃষ্টিতে ছায়াসমূহ দেখে থাকতো তা পরিবর্তন হবার কথা। প্রতিদিন একজন মানুষ ছায়া দেখে থাকে এবং এও দেখে থাকে যে দিনের বিভিন্ন সময়ে সেগুলো কিভাবে বড় থেকে ছোট এবং ছোট থেকে বড় হয়। একটা গরম দিনে, ছায়ায় বসে নিজেকে ঠান্ডা করা ছাড়া, ছায়া নিয়ে ভাবতে গিয়ে কেউ বিশেষ সময় ব্যয় করে না। কিন্তু উপরের দুটি আয়াত দৈনন্দিন জীবনের এই সাদামাটা ব্যাপারটাকেও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখার দাবী জানায়।
এই আয়াতগুলো এটা পরিষ্কার করে দেয় যে, ছায়াগুলো নিজ থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে না। একইভাবে আজকাল যেমনটি বলা হয়, ব্যাপারটাকে এই বলে ঢালাওভাবে ‘প্রকৃতির নিয়ম’ বলে শেষ করে দেয়া যায় না। বরং এই বলে “তুমি কি দেখনি কিভাবে তোমার প্রভু ছায়া ছড়িয়ে দেন?” বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ্ই প্রতিদিন এগুলো পরিবর্তন করছেন। দৈনন্দিন ভিত্তিতে আল্লাহ্ই এগুলোকে সরাচ্ছেন ও পরিবর্তন করছেন। আর তিনি যদি চান তবে তাৎক্ষণিকভাবে সকল গতি ও পরিবর্তন থেমে যাবে। যদি আল্লাহ্ তা চাইতেন, পৃথিবীর কোন শক্তিই কখনোই তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারতো না।
বিশ্বাসীগণসহ অনেক মানুষের বেলায়ই যা ঘটে থাকে, তা হচ্ছে এই যে, তাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশে আল্লাহর নিদর্শন দেখে তারা পরিতৃপ্ত ও অভ্যস্ত হয়ে যায়। তারা সেগুলোকে আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির জন্য সৃষ্টি করেছেন এমন ‘প্রকৃতির নিয়ম’ বলে ভাবতে শুরু করে। তারা সেহেতু আসলে কি ঘটে যাচ্ছে তা দেখার মত দৃষ্টিশক্তি হারায় – যার প্রতি এই আয়াতগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও এই নির্দশনগুলো তাদের চারপাশে সার্বক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তবুও এগুলো বোঝার ব্যাপারে তাদের অন্তরে আর বোধশক্তি থাকে না – কেননা, তারা এই নিদর্শনগুলোকে সঠিক পদ্ধতিতে অনুধাবন করছে না।
আমাদের চারপাশে কেবল আল্লাহর সৃষ্ট কিছু ‘নিয়ম’ কার্যরত – ব্যাপারটা বাস্তবে কিন্তু সেরকম নয়। পবিত্র কুর’আন বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যা কাউকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়: আল্লাহ্ই ওগুলোকে সারাচ্ছেন এবং তিনিই সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন, সুতরাং একজন মানুষ তার চারপাশের এই নিদর্শনগুলোকে দেখলে তার আল্লাহর কথা স্মরণ হওয়া উচিত, যাঁর সৃষ্টি ও প্রজ্ঞা সবসময়ই তার চারপাশে বর্তমান। সে যখন এই নিদর্শনগুলোকে দেখে, তখন তাকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আর এই নিদর্শনগুলো যেহেতু তার জীবনে প্রতিদিনই তার চারপাশে রয়েছে, সুতরাং সেগুলো সবসময়ই তাকে তার সৃষ্টিকর্তা ও প্রভুর কথা মনে করিয়ে দেয়। চারপাশের প্রকৃতিতে ‘আল্লাহর উপস্থিতি ও কাজের’ অনুভূতি ছাড়াও, একজন মানুষের মনে আল্লাহর বিরাটত্ব ও আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞার ধারণা জন্মায়। যিনি এই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এই পৃথিবীর কর্মকাণ্ডকে নিখুঁতভাবে সমাধা হবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তিনি নিশ্চয়ই কারো কল্পনাশক্তিতে যা ধারণ করা যায় তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি বড় ও জ্ঞানী। এই অনুভূতি পর্যায়ক্রমে কাউকে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুভূতির দিকে নিয়ে যায়: আল্লাহ্, যিনি এই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য বা কারণ ছাড়া এমনি এমনি এতকিছু সৃষ্টি করেননি। এ পর্যায়ে কেউ সৃষ্টির মাঝে নিজের একটা ভূমিকার কথা এবং তার প্রভুর কাছে তার দায়বদ্ধতা বুঝতে শুরু করে। প্রকৃতিকে অবলোকন করা এবং আল্লাহর বিরাটত্ব ও প্রজ্ঞা অনুধাবন করে এর স্বাভাবিক ও অপরিহার্য অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হবার প্রক্রিয়া কুর’আনের নিম্নলিখিত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে :
“আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এটা [অর্থাৎ, এই সব] অর্থহীনভাবে সৃষ্টি করেননি, আপনি পবিত্র, আপনি আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! কাউকে আপনি আগুনে নিক্ষেপ করলে তার লজ্জাকর অবস্থা হয় এবং যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই; হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা এক আহ্বায়ককে ঈমানের দিকে (এই) আহ্বান করতে শুনেছি: ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনো!’ সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কাজগুলো দূর করুন এবং আমাদের সৎকর্মশীলদের সাথে মৃত্যু দান করুন। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদের যা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাদের দান করুন এবং শেষ বিচারের দিনের লজ্জা থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আপনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।’ ” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০-১৯৪)
উপরের আয়াতগুলো কেবল একটা উদাহরণ। এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে, যেগুলো এই পৃথিবীর কর্মকাণ্ডের স্পষ্ট অথচ আশ্চর্যজনক দিকগুলোর প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আয়াতগুলো যে কাউকে স্রষ্টার বাস্তবতা এবং সৃষ্টির মাঝে মানুষের সত্যিকার অবস্থান কি তা মনে করিয়ে দেয়। সেগুলো থেকে পাঠক সতর্কবাণী সহকারে এমন একটা শিক্ষা লাভ করে, যা সারাজীবন তার সাথী হয়ে থাকে : (এই শিক্ষা) যে, এই মহাবিশ্ব, কোন প্রয়োজনীয়তা বা উদ্দেশ্য ছাড়াই, কাকতালীয়ভাবে সংঘটিত এক বিস্ফোরণের ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত কতগুলো বৈজ্ঞানিক নিয়ম দ্বারা গঠিত নয়। বরং এই মহাবিশ্বের কর্মকাণ্ড একজন প্রভুর ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে – যিনি মানবকুলকে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। উপরন্তু, তিনি চাইলে, সৃষ্টির নিয়মাবলীর উপর ভিত্তি করে পরিচালিত মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের তাৎক্ষণিক সমাপ্তি ঘটাতে পারেন। সুতরাং, আল্লাহ্ যে মহাবিশ্বের কর্মকাণ্ডগুলোকে যথাযথভাবে ঘটতে দিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত দয়া করছেন এবং আমাদের সকল প্রচেষ্টাকে অর্থহীনতায় পরিণত করছেন না, সেজন্য আমাদের উচিত তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ্ যদি আমাদের সফল হতে না দেন, তবে আমাদের সকল প্রচেষ্টা শূন্যতায় পর্যবসিত হবে – এই সত্যটা অনুধাবন করে আমাদের সবসময় দুর্বিনীত ভাব পরিহার করে চলা উচিত।
সূরা আল-ওয়াক্বিয়ায় এ বিষয়টা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে:
“তোমরা কি ভেবে দেখেছো তোমাদের বীর্যপাত সম্বন্ধে? তা কি তোমরা সৃষ্টি কর না আমরা সৃষ্টি করি? আমরা তোমাদের মধ্যে মৃত্যু নির্ধারিত করেছি এবং আমরা অক্ষম নই – তোমাদের গঠন বদলে দিয়ে পুনরায় নতুন রূপে তোমাদের সৃষ্টি করার ব্যাপারে – যা তোমাদের জানা নেই। তোমরা তো প্রথম সৃষ্টি সম্বন্ধে জেনেছো, তবে তোমরা অনুধাবন কর না কেন? তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্বন্ধে চিন্তা করেছো কি? তোমরা কি তা অঙ্কুরিত কর, না আমরা তা অঙ্কুরিত করি? আমরা ইচ্ছা করলে সেটাকে খড়কুটায় পরিণত করতে পারি, তখন তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে যাবে; (বলবে) ‘আমরা তো দায়গ্রস্ত হয়ে পড়েছি,’ বরং (বলবে) ‘আমরা তো সর্বস্ব হারিয়েছি।’ তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্বন্ধে তোমরা কি ভেবেছো? তোমরা কি মেঘ থেকে তা নামিয়ে নিয়ে আসো, না আমরা তা বর্ষণ করি? আমরা চাইলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না? তোমরা যে আগুন জ্বালো, তা লক্ষ্য করে দেখেছো কি? তোমরাই কি তার (জন্য জ্বালানি) বৃক্ষ সৃষ্টি কর, না আমরা সৃষ্টি করি? আমরা একে নিদর্শন ও মরুচারীদের প্রয়োজনীয় বস্তু (হিসেবে সৃষ্টি) করেছি। সুতরাং তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। ” (সূরা ওয়াক্বিয়া, ৫৬:৫৮-৭৪)
উপরোক্ত আয়াতগুলো প্রকৃতি সম্বন্ধে কারো জ্ঞান আরো বেশি সমৃদ্ধ না করলেও, তারা প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী উপহার দেয় – যে দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের চারপাশের প্রকৃতির মাঝে আল্লাহর কর্তৃত্বের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এবং সেই সঙ্গে তাঁর বিরাটত্ব ও সর্বময় জ্ঞানের কথাও আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এই ধরনের আয়াতসমূহের সঠিক অনুধাবন, একজন বিশ্বাসীর উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এই উপলব্ধি সমেত একজন বিশ্বাসী যখন তার চারপাশের প্রকৃতির দিকে চেয়ে দেখে, তখন সবসময় তার আল্লাহর কথা মনে হতে থাকে – যা তার ঈমান বৃদ্ধি করবে এবং তাকে আল্লাহর আরো নিকটবর্তী করবে। এই পর্যায়ের আলোচনার সারসংক্ষেপে আমরা আবারো বলতে চাই যে, কেউ যদি কুর’আনের দিক নির্দেশনার বৃহত্তর চিত্রটি সনাক্ত না করে, কেবল কুর’আনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময়সমূহ আবিষ্কার করতে গিয়ে তার কুর’আন অধ্যয়নের বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় করেন, তবে তিনি কুর’আনের জরুরী শিক্ষা ও এর উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ হবেন। নবীর সাহাবীগণ – যাঁরা সম্প্রতি উদ্ঘাটিত অনেক বৈজ্ঞানিক বিস্ময় সম্বন্ধেই জ্ঞাত ছিলেন না, কিন্তু প্রকৃতি ও বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত এসব আয়াত তাঁদের জীবনের জন্য কতটুকু শিক্ষণীয় তা ঠিকই বুঝেছিলেন – তাঁদের উপর কুর’আনের যে প্রভাব বাস্তবায়িত হয়েছিল, আমরা যদি কেবল বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের খোঁজে থাকি, তবে আমাদের জীবনে সেই প্রভাব প্রতিফলিত হবে না।