কারামাত সংক্রান্ত সঠিক ইসলামী বিশ্বাস
================
১২.৫ কারামাতুল আউলিয়া (كَرَامَاتُ الأَوْلِيَاء)
কারামাতুল আউলিয়া বলতে বোঝায় সৎকর্মশীলদের দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাকে। অর্থাৎ সৎকর্মশীলদের জীবনে যদি এমন ঘটনা ঘটে যাকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না, তবে তাকে কারামাত (كَرَامَة) বলা হয়। অপরপক্ষে নবীদের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বারা তাঁদের নবুওয়্যতের প্রমাণস্বরূপ সংঘটিত অতিপ্রাকৃত অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়ম বহির্ভুত ঘটনাকে বলা হয় মুজিযা। অবশ্য মুজিযা একটি পারিভাষিক শব্দ। নবীগণ তাঁদের উম্মাতসমূহের জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে যে সমস্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন সেগুলোকে আল-কুরআনে বাইয়্যেনাত, আয়াত, বুরহান ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যাহোক নবীদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে যখন কোন অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে, তাকে পারিভাষিকভাবে “কারামাত” বলা হয়। এই কারামাতের প্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে, যেমন অলৌকিকভাবে কোন বিপদ থেকে মুক্তি কিংবা কোন প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে কিংবা শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মাধ্যমে ইত্যাদি।
কারামাতুল আউলিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা পথভ্রষ্টতার একটি অন্যতম উৎস। কেননা যাদুটোনা এবং শয়তান জিনদের সাথে যোগসূত্রের মাধ্যমেও কোন কোন ভণ্ড অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটাতে পারে, যেমন: শূন্যে ভাসা, পানির ওপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে যাওয়া কিংবা পাথরের টুকরোকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করা ইত্যাদি, এগুলো কারামাতুল আউলিয়া অর্থাৎ সৎকর্মশীলদের জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশিত অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং এগুলো শয়তানী কর্মকাণ্ড, মানুষকে ধোঁকায় ফেলে জাগতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এ সমস্ত শয়তানী কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়। তাই একজন মুসলিমের কর্তব্য এ সম্পর্কে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গী জানা।
১২.৫.১ ওলী কে?
কারামাতুল আউলিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম যে প্রশ্নের উত্তর জানা থাকা আবশ্যক, তা হচ্ছে ওলী কে? আউলিয়া শব্দটি ওলী শব্দের বহুবচন। ওলী শব্দটির আভিধানিক অর্থ: অভিভাবক, রক্ষাকারী, তত্ত্বাবধায়ক, কর্মবিধায়ক, সাহায্যকারী, বন্ধু, ভালবাসার পাত্র, নিকট কেউ।
ওলী সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা এই যে কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্যশীল ওলী হতে হলে তার দ্বারা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটতে হবে। অনেকে মনে করেন যে আল্লাহর ওলী হওয়ার জন্য বিশেষ কোন ফর্মুলা আছে কিংবা বিশেষ কিছু কর্মকাণ্ড কিংবা তরীকা আছে যা সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়। কিন্তু বিষয়টি মোটেও এরকম নয়। বরং আল-কুরআনে স্পষ্টত ওলীর সংজ্ঞা দেয়া আছে, এ সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য হল:
(أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (62) الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ (63
লক্ষ্য কর, নিশ্চয় আল্লাহর ওলীদের কোন ভয় নেই, আর তারা আপসোসও করবে না। যারা ঈমান এনেছিল এবং তাকওয়া অবলম্বন করত।( সূরা ইউনুস, ১০ : ৬২-৬৩)
সুতরাং যে ঈমানদার এবং মুত্তাকী সে-ই আল্লাহর ওলী। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর সাক্ষ্য দিয়েছে এবং এরপর তাকওয়া অবলম্বন করেছে, সেই ওলী। আর মুত্তাকী বা তাকওয়া অবলম্বনকারী হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর নিষেধ করা বিষয় থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের ক্রোধ ও শাস্তি থেকে আত্মরক্ষা করেছে। অতএব ওলী হওয়ার শর্ত হল ঈমান এবং সৎকর্ম। যার ঈমান যত মজবুত, যার ইবাদত যত সুন্দর, সে আল্লাহ পাকের তত বড় ওলী। সুতরাং ওলী হওয়ার জন্য কোন গোপন সূত্র নেই, ওলী হওয়ার জন্য কোন অস্বাভাবিক কাজ করতে হয় না, ওলী হওয়ার জন্য কোন পীর সাহেবের মুরিদ হতে হয় না, ওলী হওয়ার জন্য কোন তরীকা ধরতে হয় না, বরং কুরআন ও সুন্নাতের প্রতি ঈমান রেখে যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করবে, তাকওয়া অবলম্বন করবে, সে-ই আল্লাহর ওলী। আর আল্লাহ পাকও মুমিনদের ওলী:
وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ
….আর আল্লাহ মুমিনদের ওলী। (সূরা আলে ইমরান, ৩ : ৬৮)
অতএব ওলী হওয়ার মাপকাঠি অত্যন্ত স্পষ্ট: ঈমান ও তাকওয়া। প্রত্যেক মুমিনের ঈমান অনুপাতে আল্লাহর সাথে তার নৈকট্যের অংশ রয়েছে। সুতরাং কে প্রকৃতই ওলী আর কে ভণ্ড সেটা আমরা খুব সহজেই নির্ণয় করতে পারি তার অবস্থা দেখে। যেমন কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় না করে, তবে সে যতই কেরামতী দেখাক সে কখনই আল্লাহর ওলী হতে পারে না, ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভকে যে ধ্বংস করল, সে মুত্তাকী নয়, আর তাই সে ওলীও নয়। এমনিভাবে কেউ যদি ইসলাম বিরোধী, তথা কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, তবে সে আল্লাহর নৈকট্যশীল ওলী হতে পারে না।
১২.৫.২ কারামাতুল আউলিয়া কি সত্য?
ওলী কে, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর দ্বিতীয় প্রশ্ন হল কারামাতুল আউলিয়া বলে বাস্তবিকই কিছু আছে কিনা? অর্থাৎ আল্লাহ পাকের ওলী তথা ঈমানদার, সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জীবনে অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে কিনা? এর জবাব হল: কারামাতুল আউলিয়া সত্য। কুরআন ও হাদীস এর স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং এ কথা সত্য যে আল্লাহ পাকের নৈকট্যশীল সৎকর্মশীল মুমিন মুত্তাকী বান্দাদের জীবনে অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ আল কুরআনে আল্লাহ পাক মরিয়মের(আ.) গর্ভে ঈসার(আ.) অলৌকিক জন্মের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এটা মরিয়মের(আ.) জীবনে সংঘটিত আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এক অসাধারণ কারামাত।
তেমনি আল কুরআনে সূরা আল কাহফে আসহাবে কাহফের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যার সারমর্ম এই যে কতিপয় ঈমানদার যুবক দেশের শাসকের দ্বারা শিরকে লিপ্ত হতে বাধ্য হওয়ার ভয়ে একটি গুহায় আশ্রয় নেয়, অতঃপর আল্লাহ পাক তাদেরকে সৌর বছরের হিসেবে ৩০০ বছর এবং চাঁদের হিসেবে ৩০৯ বছর ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন, এত দীর্ঘ সময় তারা পানাহার ছাড়াই বেঁচে ছিল আল্লাহ পাকের ইচ্ছায়। এটাও কারামাতের উদাহরণ।
তেমনি হাদীসে বর্ণিত: একবার তিনজন ব্যক্তি একটি গুহায় আটকা পড়ার পর তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে সালিহের মাঝে অত্যন্ত ঐকান্তিকতা সহকারে সম্পাদিত একটি আমলের ওসীলায় আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করল যে তিনি যেন তাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, ফলে একজন পিতামাতার প্রতি তার যত্নের ওসীলা দিয়ে প্রার্থনা করল, একজন আল্লাহর ভয়ে ব্যভিচার থেকে ফিরে আসার ওসীলা দিয়ে প্রার্থনা করল, তৃতীয়জন তার অধীন এক কর্মচারীর পাওনা সম্পদ উত্তমরূপে হেফাযত করা এবং তা পূর্ণ ও বর্ধিত মাত্রায় তাকে ফিরিয়ে দেয়ার ওসীলা দিয়ে প্রার্থনা করল, প্রত্যেকের দু’আয় গুহার মুখে চেপে বসা পাথর একটু করে ফাঁক হতে লাগল, অবশেষে তারা বের হয়ে আসতে সক্ষম হল।[বুখারী(২২১৫), মুসলিম(২৭৪৩)] এটিও কারামাতের উদাহরণ।
১২.৫.৩ শয়তানী কর্মকাণ্ড থেকে কারামাতুল আউলিয়ার পার্থক্য
যাদুটোনা এবং জিনদের সহায়তায় সংঘটিত শিরকপূর্ণ শয়তানী কর্মকাণ্ডের দ্বারাও বাহ্যিকভাবে কারামাতের অনুরূপ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শয়তানী কর্মকাণ্ডের সাথে কারামাতের পার্থক্য করার জন্য দেখতে হবে: যে ব্যক্তির মধ্যে এর প্রকাশ ঘটেছে, সে ঈমানদার, মুত্তাকী, সৎকর্মশীল কিনা। যদি কোন অসৎ, বদচরিত্রের লোকের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ পায়, তবে বোঝা যাবে যে এটা শয়তানী কর্মকাণ্ড। কেউ যদি শূন্যে ভেসে থাকে, কিংবা পানির ওপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে যায় অথবা একখন্ড পাথরকে স্বর্ণে পরিণত করে ইত্যাদি তবে তাকে ওলী মনে করার কোন কারণ নেই, আর এই ঘটনাকে কারামাত মনে করার কোন কারণ নেই, কেননা জিনদের সহায়তায় এগুলো ঘটানো সম্ভব, আর যারা জিনদের সহায়তায় এগুলো ঘটায়, তারা জিনদেরকে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নানাপ্রকার শিরকী ও কুফরী কাজ করে থাকে।
তাই বলা যায় যে পাপাচারী, বদচরিত্রের লোকদের দ্বারা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটলে সেটাকে শয়তানী কর্মকাণ্ডের অংশ ও ভণ্ডামি হিসেবে গণ্য করতে হবে।
তেমনি কেউ যদি কোন অস্বাভাবিক ঘটনার ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় এবং তাদের আনুগত্য দাবী করে, তবে সেটাও ভণ্ডামি হওয়ারই সম্ভাবনা, কেননা কোন প্রকৃত সৎকর্মশীল ব্যক্তির জীবনে অলৌকিক ঘটনা ঘটলে সে নিজে এর প্রশংসা করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কিংবা প্রশংসা কুড়াতে চাইবে না, বরং সে তা লুকাতে চাইবে। কেননা প্রকৃতপক্ষে সৎকর্মশীল ব্যক্তি এক আল্লাহকেই সন্তুষ্ট করতে চায়, তাই এমন ব্যক্তি মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য নিজের আমলগুলোকে বিনষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
তেমনি কোন অস্বাভাবিক ঘটনা সংঘটনের মাধ্যমে যদি ইসলামী শরীয়ত বিরোধী কোন কিছুর প্রতি আহবান করা হয় কিংবা শরীয়তবিরোধী কোন বিষয়ের সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করা হয়, তবে সেটাকে শয়তানী কর্মকাণ্ড ও ভণ্ডামির অংশ মনে করতে হবে। যেমন ধরা যাক কোন তথাকথিত পীর সাহেব যদি তার মুরিদদেরকে ইসলাম বিরোধী, শরীয়ত বিরোধী কাজকর্মের নির্দেশ দেয় [যেমন তাকে সেজদা করতে বলে, অথবা নারীদেরকে তার সান্নিধ্যে আসতে নির্দেশ দেয়] এবং অতঃপর তার কাজকর্মের বৈধতা প্রমাণের জন্য কোন অলৌকিক অস্বাভাবিক ঘটনার প্রকাশ ঘটায়, তবে নিশ্চিতভাবেই সে শয়তানী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, কেননা শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক কারামাত দান করবেন, এটা সম্ভব নয়!
১২.৫.৪ কারামাতের তাৎপর্য
আউলিয়াদের কারামাতের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল: কারামাতের তাৎপর্য কি? অর্থাৎ কেন আল্লাহ পাক কতিপয় সৎকর্মশীলদের জীবনে অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন?
এর একটি কারণ হল সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের প্রয়োজন পূরণ করা, তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করা – এ সবই তাদের সৎকর্মের প্রতিদান ও পুরস্কারের অংশ।
দ্বিতীয়ত, এটি ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ এবং ভাল লক্ষণ এবং সম্মান। তবে এক্ষেত্রে তাঁকে সতর্ক হতে হবে যে তিনি যেন এর প্রচার করে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর চেষ্টা না করেন, কেননা সেক্ষেত্রে এই বিরাট নিয়ামত তার জন্য ফিতনা এবং শাস্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে, তিনি আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় না করে যখন মানুষের মাঝে নিজের প্রচার চাইবেন, তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ থেকে সরে আসলেন এবং তাঁর আমলগুলোকে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন করে দিলেন। বরং এ ধরনের ঘটনা কারও জীবনে ঘটলে তার কর্তব্য একে গোপন রাখা, আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করা এবং আরও বেশী করে তাঁর দিকে ঝুঁকে পরা, আরও উত্তমরূপে আল্লাহ পাকের ইবাদত বন্দেগী করা।
তৃতীয়ত এটি এই ব্যক্তির দীনের সত্যতার প্রমাণ, এবং তিনি যে নবীর অনুসারী, সেই নবীর নবুওয়্যতের সত্যতার প্রমাণ। তাই উম্মাতে মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তথা মুহাম্মাদের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারীদের মাঝে যে সমস্ত কারামাত প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো মূলত এ কথাই প্রমাণ করে যে নবী মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য নবী, তাঁর প্রচারিত বার্তা সত্য, সঠিক এবং দীন ইসলাম সত্য।
১২.৫.৫ কারও দ্বারা কারামত প্রকাশ পাওয়া প্রমাণিত হলে তাকে আমরা কি চোখে দেখব, এ ব্যাপারে আমাদের আকীদা কি হবে?
এটি কারামাতে আউলিয়া সংক্রান্ত আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। অর্থাৎ আল্লাহর কোন ওলী, মুমিন, মুত্তাকী, সৎকর্মশীল ব্যক্তির জীবনে অতিপ্রাকৃত কিংবা অলৌকিক কোন ঘটনা ঘটলে এ ব্যাপারে আমাদের আকীদা কি হবে, এবং এই ব্যক্তির ব্যাপারে আমাদের আচরণ কি হবে?
১২.৫.৫.১ কারামত সংক্রান্ত সকল বর্ণনাই সঠিক নয়
প্রথমত, কারামত সংক্রান্ত সকল বর্ণনাই গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ অমুক ব্যক্তির জীবনে অমুক অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে – এরকম বর্ণনা প্রচলিত থাকলেই তা সত্য হবে কিংবা গ্রহণ করা যাবে এমন নয়, বরং যাচাই করতে হবে এমনটি সত্যিই ঘটেছে কিনা। যাচাই না করে এগুলো বর্ণনা করা যাবে না। বরং এ সংক্রান্ত প্রচলিত অনেক ঘটনাই প্রকৃতপক্ষে বানোয়াট এবং অতিরঞ্জিত গালগল্প।
১২.৫.৫.২ কারামত আল্লাহ পাকের সৃষ্টি
দ্বিতীয়ত, এরকম কোন ঘটনা প্রমাণিত হলে সেক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে এই অতিপ্রাকৃত ঘটনা আল্লাহ কর্তৃক সংঘটিত, এতে ঐ ব্যক্তির কোন হাত নেই, তিনি নিজে এই ঘটনা ঘটাতে সক্ষম নন, এটা তার নিয়ন্ত্রণেও নেই যে তিনি চাইলেই যখন খুশী তা সম্পাদন করতে পারেন। বরং যখন আল্লাহ চেয়েছেন, তখনই ঐ ব্যক্তির জীবনে ঐ ঘটনার প্রকাশ ঘটেছে। আর তাই আল্লাহ পাকের ক্ষমতার কোন অংশ এই ব্যক্তির ওপর আরোপ করা যাবে না, কিংবা এই ব্যক্তিকে আল্লাহর পাশাপাশি বিশ্বজগতের কলকাঠি নাড়তে সক্ষম বলে মনে করা যাবে না, যদি এরকম ধারণা পোষণ করা হয় তবে তা হবে শিরক বা আল্লাহর অংশীদার বানানো।
১২.৫.৫.৩ [sb]কারামত প্রকাশ পাওয়া অর্থ এই নয় যে এই ব্যক্তি শরীয়তের উৎস
তৃতীয়ত, এ কথা জানা আবশ্যক যে কোন ব্যক্তির মাঝে কারামাত প্রকাশ পাওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি শরীয়তের উৎস। বরং শরীয়তের উৎস হল কুরআন এবং সুন্নাহ। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাতের পাশাপাশি এই ব্যক্তির কোন কথা, কাজ, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আদেশ কিংবা নিষেধকে শরীয়তের উৎস কিংবা শিরোধার্য মনে করা যাবে না, বরং তার কথা, কাজ, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আদেশ কিংবা নিষেধকে কুরআন এবং সুন্নাতের মাপকাঠিতে যাচাই করে দেখতে হবে: যদি তা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হয়, তবে তা গ্রহণ করা যাবে, যদি তা কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধী হয়, তবে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তার কারামাত প্রকাশ পাওয়ার আগেও যেমন তার কথা, কাজ, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আদেশ ও নিষেধগুলো কুরআন ও সুন্নাতের অনুমোদনের মুখাপেক্ষী, তেমনি কারামাত প্রকাশ পাওয়ার পরও তাঁর কথা, কাজ, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আদেশ কিংবা নিষেধ কুরআন ও সুন্নাতের অনুমোদনের মুখাপেক্ষী। সুতরাং তিনি যদি এমন কোন নির্দেশ দেন যা শরীয়তের বিরোধী, তবে তার নির্দেশ অমান্য করে শরীয়ত পালন করতে হবে। যেহেতু তিনি আল্লাহর ওলী, যেহেতু তার মাঝে কারামাত প্রকাশ পেয়েছে, অতএব তার কথা মানতে হবে – এ কথা বলা যাবে না। তিনি কোন বিষয়ে কোন মত কিংবা সিদ্ধান্ত দিলে সেটা গ্রহণ করা যাবে যদি তা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হয়, নতুবা তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে, তার মাঝে কারামতের প্রকাশ ঘটুক বা না ঘটুক। মোটকথা কারামাত প্রকাশ পাক বা না পাক শরীয়তের উৎস সবসময়ই কুরআন ও সুন্নাহ, এর বাইরে অন্য কোন ব্যক্তির কথা, কাজ, আচরণ, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আদেশ কিংবা নিষেধ – এর কোনটিই শরীয়তের উৎস নয়, এগুলো থেকে শরীয়তের কোন বিধান নেয়া যাবে না, বরং এগুলোকে কুরআন ও সুন্নাতের মাপকাঠিতে পরখ করে দেখতে হবে, যদি তা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হয় তবে তা গ্রহণ করা হবে, যদি তা কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধী হয় তবে তা বর্জন করতে হবে।
১২.৫.৬ কারামাতের সারমর্ম
কারামাত সংক্রান্ত এই আলোচনার পর যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির নিকট এ সংক্রান্ত পথভ্রষ্টতাগুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে।
সমাজে বহু ভণ্ড লোককে মানুষ আল্লাহর ওলী মনে করে শুধুমাত্র এ কারণে যে তারা কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু আমরা জানলাম যে এ ধরনের ঘটনা শয়তানী কর্মকাণ্ডও হয়ে থাকে। সুতরাং এ ধরনের ঘটনা দেখে কাউকে আল্লাহর ওলী মনে করা যাবে না। বরং সে যদি শরীয়ত বিরোধী নির্দেশ দেয় কিংবা মানুষের কাছে টাকাপয়সা চায়, তবে বুঝতে হবে যে সে ভণ্ড, প্রতারক, শয়তানের সঙ্গী।
দীনের নামে প্রচলিত অনেক বিধানের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে যে অমুক ওলী এই আমল করেছেন, তাই আমাদেরকে এই আমল করতে হবে, কিংবা অমুক ইমাম এই আমল করেছেন, তাই আমাদেরকেও তা করতে হবে। আমরা বুঝতে পারলাম যে এ কথাগুলো ঠিক নয়। ঐ ওলী বা ঐ ইমামের মাঝে কারামাত প্রকাশ পেলেও তার অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য নই। বরং তাঁর শেখানো কোন আমলের পক্ষে যদি কুরআন এবং সুন্নাতের দলীল থাকে, কেবলমাত্র তখনই তা গ্রহণযোগ্য হবে, নতুবা তা বর্জনীয়, তিনি যত বড় ওলী বা ইমামই হোন না কেন।
-০-
উপরের বক্তব্য আপনারা চাইলে সরাসরি এখানেও দেখতে পাবেন: