করণীয়/বর্জনীয় – ১

১৮ ই নভেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:১০

আমাদের পাড়ার মসজিদের ৩ নং হুজুর, অনেক সময়ই কোন এক ওয়াক্তের নামাজের পর “বাকী নামাজের পরে বারান্দায় মিলাদ আছে, যে যে পারেন শরীক হতে চেষ্টা করবেন”—এ ধরনের ঘোষণা দিয়ে থাকেন। আমি কখনোই সেই ’যে যে পারেনের’ দলে থাকতে পারিনি, তবে অনুমান করতে পারি যে, ঐ সব মিলাদ খুব সম্ভবত, কারো পরীক্ষায় ভালো করার জন্য দোয়া চেয়ে, অথবা পরীক্ষায় ভালো করার পর শুকরিয়া জানিয়ে, বা কারো রোগমুক্তির জন্য দোয়া চেয়ে, অথবা কোন মৃত স্বজনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বা একই ধরনের কোন উপলে আয়োজিত। আমি ভাবতে চেষ্টা করেছি যে, কি ধরনের মানসিক অবস্থায় কোন মিলাদের আয়োজক, অর্থাৎ যিনি মিষ্টি ইত্যাদি বা ঐ মিলাদের আনুষঙ্গিক খরচ বহন করছেন, তিনি এই ’ভাবগম্ভীর’ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছেন? আমি উপরে যে কারণগুলোর কথা উল্লেখ করছি, সে সব কারণে যদি তিনি মিলাদের আয়োজন করে থাকেন, তবে ধরে নিতে হবে যে, তিনি একজন বিশ্বাসী — কারণ, তার কোন উপস্থিত জাগতিক প্রাপ্তি নেই ঐ খরচের বিনিময়ে — তিনি “বিশ্বাস” করছেন যে, তার ঐ পুণ্যময় আয়োজনের বিনিময়ে আল্লাহ্ তাকে কিছু একটা দেবেন। একজন অবিশ্বাসীর জন্যও মিলাদের আয়োজন করা সম্ভব, তবে তা হবে কোন তাৎক্ষণিক জাগতিক অর্জনের জন্য, যেমনটা ধরুন “জনগণকে” ফু্সলাতে ভোটের মৌসুমে কোন অবিশ্বাসী তাগুত নেতাও মিলাদের আয়োজন করতে পারেন।

রাসূল (সা.) বিশুদ্ধ ও সন্দেহমুক্ত হাদীসে বলে গেছেন যে, মানবকুলের মাঝে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে তাঁর প্রজন্ম, তার পর তার পরের প্রজন্ম এবং তার পরে তার পরের প্রজন্ম । বলা বাহুল্য এই শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে মুসলিম হিসেবে গুণগত মানের শ্রেষ্ঠত্ব — ঐশ্বর্য্য বা বস্তুবাদী শ্রেষ্ঠত্ব নয়। রাসূল (সা.)-এঁর মুখনিসৃত দ্বীন সংক্রান্ত প্রতিটি কথা, মন্তব্য ও অনুশাসন আমাদের জন্য প্রশ্নাতীত ভাবে শিরোধার্য এবং তিনিই হচ্ছেন একমাত্র মানুষ যার প্রতিটি আদেশ ও নিষেধ প্রশ্নাতীত ভাবে মেনে নিতে আমরা, মুসলমিরা, বাধ্য — অন্তত যতক্ষণ আমরা নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দিতে চাইবো। তাহলে তাঁর কথামত শ্রেষ্ঠ মুসলিম যারা – অর্থাৎ প্রথম তিন প্রজন্মের মুসলিমগণ – তাঁদের চেয়ে কি আমাদের আমল, আখলাক, আকীদাহ বা ইবাদতের পদ্ধতি শ্রেষ্ঠতর বা বিশুদ্ধতর হতে পারে? যারা রাসূল (সা.)-কে দেখেছেন, যাদের সামনে রাসূল (সা.)-এঁর কাছে কুর’আনের বাণী নাযিল হয়েছে, যারা বিদায় হজ্জ্বে আরাফাতের ময়দানে তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলেন, যারা তাঁর সাথে বদর, ওহুদ বা তাবুকের অভিযানে অংশ নিয়েছেন, তাঁর মাথার একটি চুল যারা স্নেহ ও শ্রদ্ধাভরে মাটি থেকে তুলে নিয়েছেন, অথবা যারা তাঁর গৃহে বড় হয়েছেন বালক হিসেবে [যেমন, আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.)] — এঁদের চেয়ে আমরা রাসূল (সা.)-কে বেশী জানবো, বেশী বুঝবো বা বেশী ভালোবাসবো, এমনটা ভাবা অত্যন্ত প্রাথমিক যুক্তিতেই একটা অর্বাচীনের কাজ বলে গণ্য হবে — বুঝিবা একধরনের বে-আদবীও বটে।

সুনান ইব্নে মাজায়, আব্দুল্লাহ ইব্নে মাস্উদ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) তাঁদের “খুতবাতুল হা’জা” বা “প্রয়োজনীয় খু্তবা” বলে একটা খুতবা এমনভাবে শিক্ষা দিতেন (অর্থাৎ এমন ধরনের গুরুত্ব সহকারে), যেমন ভাবে তিনি তাঁদের কুর’আনের আয়াত শিক্ষা দিতেন। তিনি তাঁদের নির্দেশ দেন যে, তাঁরা যেন তাঁদের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ড উক্ত খুতবা দ্বারা শুরু করেন। সে জন্য ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী আমরা দেখি যে, জুম্মার খুৎবাই হোক অথবা ঈদের খুৎবাই হোক অথবা বিয়ের খুৎবাই হোক — যে কোন গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের শুরুতে, দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব যারা, তারা রাসূল (সা.)-এঁর দিক নির্দেশনা মোতাবেক খুতবাতুল হা’জার বক্তব্য বা তার সদৃশ বক্তব্য দিয়ে তাঁদের কর্মসূচীর সূচনা করতেন।

দ্বীন ইসলামের বৈশিষ্ট্য এবং আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর ক্রীতদাস হিসেবে, আমাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কেমন হওয়া উচিত, তা অনুধাবন করার ব্যাপারে, এই খুৎবার সারমর্ম অনুধাবন করাটা অত্যন্ত সহায়ক হবার কথা। আমরা সেজন্য খুতবাতুল হা’জার আরবী উচ্চারণ এবং অর্থ, পাঠক তথা সকল দ্বীনী ভাইবোনদের অবগতির জন্য এখানে উদ্ধৃত করবো ইনশা’আল্লাহ!

[sb]আরবী উচ্চারণ:
“ইন্নাল হামদালিল্লাহ্ – নামাদুহু ওয়া নাস্তায়িনুহু ও নাস্তাঘফিরুহ্ – ওয়া নাউযুবিল্লাহি মিন শুরুরি আনফুসিনা ওয়া মিন সাইয়িআতি ‘আমালিনা। মাই ইয়াহদিহিল্লাহু ফালা মুদিল্লালাহ্, ওয়ামাইউদলিল ফালা হাদিয়ালাহ্। ওয়া আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহ্ – ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু। আম্মাবা‘দ। ফা ইন্না খাইরাল কালামি (অন্য র্বণনায়, হাদীসি) কালামুল্লাহ্ – ওয়া খাইরাল হাদি, হাদিউ মুহাম্মাদিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম। ওয়া শাররুল উমুরী মুহদাসাতুহা – ওয়া কুল্লা মুহ্দাসাতিন বিদা’ – ওয়া কুল্লা বিদাতীন দালালা, ওয়া কুল্লা দালালাতীন ফিন্নার।”

এখানে রাসূল(সা.) যা বলেন তার ভাবার্থ হচ্ছে: অবশ্যই সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহরই প্রাপ্য। তাই আমরা তাঁর প্রশংসা করি এবং আমরা তাঁর সহায়তা ও সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা তাঁর মাঝে আমাদের নিজেদের আত্মার অমঙ্গলময়/পাপপূর্ণ প্ররোচনা থেকে এবং তার পরিণতিতে আমাদের নিজেদের পাপকর্ম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ্ যাকে পথ দেখান, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না — কিন্তু আল্লাহ্ যাকে বিপথগামী হতে দেন, তাকে কেউ পথ দেখাতে পারে না। আমি স্যা দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং তার কোন শরীক নেই এবং আমি এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ক্রীতদাস এবং (শেষ) রাসূল। অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহর কিতাব — কুর’আন, এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দিক নির্দেশনা (হেদায়েত) ও উদাহরণ হচ্ছে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এঁর উদাহরণ। দ্বীনের ব্যাপারে এবং আল্লাহর ইবাদত করার ব্যাপারে কেউ সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে কাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে তাঁর উপাসনা করার এবং তাঁর নৈকট্য লাভের নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন করা — কেননা প্রতিটি নতুন ভাবে উদ্ভাবিত পন্থা হচ্ছে একেকটি নব্য-প্রথা (বা বিদ্আত) — এবং প্রতিটি নব্য-প্রথা হচ্ছে একটি বিচ্যুতি বা পথভ্রষ্টতা (দালালা বা misguidance) — আর সেই পথভ্রষ্টতা (যে কাউকে) জাহান্নামের আগুনে নিয়ে যায়।

এভাবে কথাগুলো উপস্থাপন করে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার শুরুতে রাসূল(সা.) যে ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করে দিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে এই সত্যতা যে, আল্লাহ্ হচ্ছেন অসীম ঐশ্বর্যশালী —আল্-গনী — এবং তিনি হচ্ছেন সকল প্রয়োজনের উর্ধ্বে — স্বাধীন! এবং সেই নিরিখে তাঁর সৃষ্টি — তা সে নবী রাসূলদের মত বিশেষ ব্যক্তিবর্গের কথাই বলা হোক, অথবা, আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কথাই ধরা হোক — আমরা অপরিহার্যভাবে আল্লাহর দিক নির্দেশনা, তাঁর সাহায্য ও তাঁর সহায়তার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর মুখাপেক্ষী। এবং এই ‍‍”খুতবাতুল হা’জা” তার বক্তাকে এবং শ্রোতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কোন মঙ্গলময় বাণী যেমন আল্লাহর দয়া ও তাঁর অনুমোদিত সামর্থ্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না — তেমনি কোন হৃদয় তাঁর দয়া বা তাঁর দেয়া সামর্থ্য ছাড়া সেই মঙ্গলবার্তা আত্মস্থও করতে পারবে না। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’লার দিক নির্দেশনা ব্যতীত আত্মার পরিশোধন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সৎকার্য সমাধা করাও সম্ভব নয়। সুতরাং এই খুতবা আল্লাহর সাহায্য যেমন প্রার্থনা করে, তেমনি আল্লাহর দিক নির্দেশনা যে আমাদের জন্য অপরিহার্য তারও স্বীকারোক্তি ও ঘোষণা প্রদান করে।

যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের শুরুতে এই বিশেষ খুৎবার বাণীটুকু উচ্চারণ করার প্রয়োজনীয়তা, এখনকার দুঃসময়ে বুঝি যে কোন পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেশী। আজ আমরা সময়ের এমন এক অববাহিকায় এসে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে আমাদের দুর্বিনীত হতে রীতিমত শিক্ষা দেয়া হয় — আপনি যত দুর্বিনীত হবেন — যত বেশী “হামসে বড়া কৌন হ্যায়” মত ভাব দেখাতে পারবেন, আপনাকে তত আত্মবিশ্বাসী বলে গণ্য করা হবে। আজ তাই রাজনৈতিক বক্তৃতা থেকে শুরু করে ; কোন খেলা শেষে সফল খেলোয়াড়ের সামনে যখন মাইক্রোফোন ধরা হয়, তখন অগণিত বার ‘আমি’ এই করেছি বা “আমরা” সেই করেছি, এমন কথা উচ্চারিত হতে শোনা যায় দম্ভ সহকারে। আজকাল, আমরা প্রতিনিয়ত ভুলে যাই যে, পৃথিবী জুড়ে কিলবিল করা সাড়ে ছয় শত কোটি মানুষের মাঝে যে কোন ব্যক্তি হচ্ছেন মাত্র ’একজন’ — গতকাল জন্ম হবার পূর্বের এক ফোঁটা নাপাক বীর্য এবং আগামীকালের মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ের গলা-পচা মাংস ঢাকা হাড়গোড়। এই দেখুন না গত প্রায় দুই দশক ধরে, পৃথিবীতে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হবার ফলে, একচ্ছত্র ক্ষমতার যে দাপট এবং অহমিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ অন্ধপ্রায় — তার হোতা, অত্যন্ত উদ্ধত প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কি করুণ অবস্থায় মৃত্যু হলো। অথচ, যারা তার দম্ভোক্তিগুলো মনে করতে পারেন, তারা নিশ্চয়ই অবাক হবেন এই ভেবে যে, অমন উদ্ধত ব্যক্তিটি, Alzheimer’s disease-এ আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর আগে নিজের নামটিও হয়তো ঠিকমত মনে রাখতে পারতেন না। আজ তার উত্তরসূরী, ফেরআউনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বিশ্ববাসীকে চোখ রাঙান এই বলে যে, “হয় তার দলে যোগ দিতে হবে” না হয় “পরিণতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে” — দু’দিন পরে কৃমি বা কীটের খাদ্যে রূপান্তরিত হবে যে নশ্বর দেহ, তার অধিকারীর কি সীমাহীন ঔদ্ধত্য!

পশ্চিমা বস্তুবাদী অবিশ্বাসী সমাজে তো বটেই, আমাদের দেশের মত মুসলিম প্রধান দরিদ্র দেশেও সাফল্যকে কেবলমাত্র উচ্চাকাঙ্খা, উদ্যম ও ব্যক্তিগত সংকল্পের variable হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদের এমন একটা ধারণা দেওয়া হয় যে, দিগন্ত বা আকাশও অজেয় বা অস্পৃশ্য কিছু নয়। আপনি কেবল মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পরে “সফল” ছাত্র-ছাত্রীদের যে সব সাক্ষাৎকারগুলো ওঠে – সেগুলোর কোনটিতে কি মনে করতে পারেন যে, কেউ তার উত্তর “আলহামদুলিল্লাহ্” বলে শুরু করেছে? বলেছে, ’আল্লাহর ইচ্ছায় বা আল্লাহর রহমতে আমি এমন ভালো করতে পেরেছি’? ২০০৪ সালের নভেম্বরে দেশে ফিরে, সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একটি বিজ্ঞাপনের ”বিল বোর্ডের” মূলমন্ত্র যেন হঠাৎই আমার চোখে পড়লো: ”রুখবে আমায় কে” – এমনও হতে পারে যে, এই দম্ভোক্তি হয়তো আগেও টাঙ্গানো ছিলো, আমার চোখে পড়েনি। এই যে ইচ্ছা থাকলেই “আমি” সব করতে পারি — এই ভাবটা সম্পূর্ণ অনৈসলামিক এবং ইসলামী মূল্যবোধের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। বরং মুসলিমদের একটা অভিব্যক্তি রয়েছে, যেটাকে রাসূল (সা.) জান্নাতের রত্নভান্ডারের একটি বাণী বলে আখ্যায়িত করেছেন — “লা ‘হাওলা ওয়া লা ক্কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্” — কেবল আল্লাহ্ ছাড়া, গতির বা ক্ষমতার আর কোন উৎস নেই — এমন একটা অর্থ দাঁড়ায় আরবী ঐ অভিব্যক্তির। ইসলামের বাণীর প্রাণকেন্দ্রে তথা একজন মুসলিমের ব্যবহারের মূলে যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা হচ্ছে ’বিনয়’ — প্রাথমিক ভাবে আল্লাহর প্রতি বিনয়-অবনত দাসত্বের অনুভব — এবং সেটা থেকে সাধারণ ভাবে গোটা পৃথিবীর সকল ক্ষেত্রে ও বিষয়ে এবং সকল কর্মকাণ্ডে ঔদ্ধত্য পরিহার করে বিনয়ের আশ্রয় নেয়া। প্রতিনিয়ত এই সত্যতাটুকু অনুধাবন করা যে, আমরা যদি এমনকি একটা সৎ স্বভাব বা চরিত্রও অর্জন করে থাকি, সেটাও আল্লাহর করুণা সাপেক্ষে অর্জিত হয়েছে — কোন “আমিত্বের” বলে অর্জিত হয় নি। যখনই কেউ কোন অর্জনের জন্য নিজের উদ্যম, চরিত্র, বুদ্ধি বা কর্ম ক্ষমতাকে বাহ্বা দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে শুরু করবেন, মুসলিম হিসেবে তার ঈমান তখন দ্রবীভূত হতে শুরু করবে এবং তার ‘আমিত্ব’ বা অহমিকা তার ও আল্লাহর মাঝে এক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। সেজন্যই যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শুরুতে এই ’খুতবাতুল হা’জা’ পাঠ করলে তা আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে, আল্লাহর উপর আমরা সার্বক্ষণিক ভাবে নির্ভরশীল এবং আমাদের সকল অর্জন কেবলই আল্লাহর করুণা-সাপেক্ষ অর্জন — স্বনির্ভর কিছু নয়। [হঠাৎ মনে হলো, আমাদের দেশের হুজুরদের, আমার এই জীবনে, এই খুতবা দিয়ে কোন আলোচনা বা অনুষ্ঠান শুরু করতে শুনেছি বলে আমি খুব একটা মনে করতে পারি না – আমার স্মৃতিতে বরং ”বালাগাল উলা বি কামালিহী” ধাঁচের শ্লোকই বেশী জীবন্ত – কি জানি আমি হয়তোবা miss করেছি!]

করণীয়/বর্জনীয় – ২

১৯ শে নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৩৯
’খুতবাতুল হা’জার’ পরবর্তী কথাগুলো আমাদের বর্তমান দুঃসময়ে বোধকরি আরো বেশী প্রয়োজনীয় ও ভাববার বিষয়। কিন্তু সরাসরি সে অংশের বক্তব্যে যাবার আগে আমার মনে হয় পাঠকের কাছে, এবং, সেই সুবাদে আমার নিজের কাছেও, ব্যাপারগুলোকে সহজে বোধগম্য করার জন্য একটু ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে।

বিদায় হজ্জ্বের সময় নাযিলকৃত সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন : “……আজকের এই দিনে আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম (সবদিক দিয়ে নিখুঁত করে দিলাম), তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম…।” এই আয়াত নাযিল হবার পর রাসূল (সা.) মাত্র ৮১/৮২ দিন বেঁচে ছিলেন এবং এই সময়ের ভিতর দ্বীনের বিধান, আইন বা নতুন কোন অনুশাসন সমেত কোন আয়াত যে নাযিল হয়নি, সে ব্যাপারে তফসীরকারগণ একমত। আমাদের দ্বীনের বিধি-বিধানের অপর যে সূত্র — অর্থাৎ রাসূল (সা.) — তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে, শরীয়াহ্ তথা ইবাদতের বিধি-বিধান, নিয়মকানুন, করণীয়/বর্জনীয় ইত্যাদির ব্যাপারে নতুন কোন মাত্রা যোগ হবার আর কোন উপায়ই রইলো না। সুতরাং রাসূল (সা.)-এঁর মৃত্যুর মুহূর্ত থেকে কিয়ামত অবধি সকল মুসলিমের দিক নির্দেশনার জন্য কেবল দু’টো সূত্র রইলো — আল্লাহর ভাষ্যমতে, ‘সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ কুর’আন’ আর রাসূল (সা.)-এঁর সুন্নাহ্ — ব্যস্। আর কোন নবী, নতুন কোন বাণী নিয়ে -বা- আমাদের নতুন করে কোন শিক্ষা দিতে, কখনো আমাদের মাঝে আসবেন না ।

জীবনের পার্থিব ব্যপারে নতুন নতুন যে সব সমস্যা আসবে, সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে ফুকাহা বা ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা শরীয়াহর উপর ভিত্তি করে বাছ-বিচার করবেন এবং ফতোয়া দেবেন — যা সাধারণেরা অনুসরণ করবেন — কিন্তু শরীয়াহ্ অপরিবর্তিত থাকবে। যে নীতির উপর ভিত্তি করে নতুন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা অপরিবর্তনীয়। উদাহরণস্বরূপ ধূমপান যে মানুষের মৃত্যুর কারণ বা বিষপানের সমতুল্য – এই ব্যপারটা না জানা পর্যন্ত অপচয়, বাহুল্য বা কূটগন্ধ উদ্রেককারী ইত্যাদির জন্য প্রযোজ্য নীতির উপর ভিত্তি করে, ধূমপানকে ’মাকরুহ্’ বলা হতো — কিন্তু আজ জীবন হরণকারী ক্ষতিকারক বস্তু হিসেবে সিগারেট চিহ্নিত হবার পর, ধূমপানকে অধিকাংশ ফিকাহ শাস্ত্রবিদই ’হারাম’ বলে রায় দিয়ে থাকেন। এখানে দেখুন “শরীয়াহ্-principle”-এর কোন পরিবর্তন হয় নি, কিন্তু ফতোয়া পরিবর্তিত হয়েছে। আজ ধরুন যদি অপর একটি বস্তু ‘X’ আবিষ্কৃত হয়, যা মানুষের জন্য পান করা একেবারেই বাহুল্য এবং কূট গন্ধ ছড়িয়ে যা অন্যের বিরক্তির উদ্রেক করে, তবে হয়তো শরীয়াহর ঐ একই নিয়মের আলোকে সেটাকে “মাকরুহ্” বলে গণ্য করা হবে। কিন্তু ধরুন দৈবাৎ কোন কারণে দেখা গেল যে, সিগারেটের উপর গবেষণাসমূহ সব ভুল ছিল এবং সিগারেট আদৌ ক্ষতিকর কোন বস্তু নয় বরং তা সেবন করলে মানুষের মঙ্গল হয় — তবে শরীয়াহর যে নীতির আলোকে সেটাকে “হারাম” বলা হচ্ছিল, সেই নীতি আর সিগারেটের বেলায় প্রযোজ্য থাকবে না। এভাবে একটু বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ভেবে দেখলে সহজেই বোঝা যাবে যে, কিয়ামত পর্যন্ত শরীয়াহর মূল যে কাঠামো তা কিছুতেই পরিবর্তন হবার নয়জীবনে নতুন নতুন পরিস্থিতির বা বস্তুভিত্তিক আয়োজনের প্রেক্ষিতে শরীয়াহ্ ভিত্তিক রুলিং বা ফতোয়া হয়তো পরিবর্তিত হবে। অনাগত “জীবন”-কে হত্যা করা যাবে না — এটা হচ্ছে গর্ভধারণ সংক্রান্ত ব্যাপারে শরীয়াহর সাধারণ দিক নির্দেশনা — এর অন্যথা হতে পারে, মার জীবনের উপর যদি কেবল ঝুঁকি আসে তবে। গর্ভধারণের কোন পর্যায়-কে “জীবন” বলবো আমরা, সে নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে (যেমন ধরুন কেউ কেউ শুরু থেকেই নিষিক্ত ডিম্বাণুকে ’জীবন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ’কপার-টি’ জাতীয় জন্মনিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থাকে হারাম বলতে চান। আবার কেউ কেউ বলতে চান যে ভ্রুণের বয়স ৪০ দিন হবার পূর্বে কেউ যদি “এম.আর” জাতীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তবে তা ’জীবন’ নষ্ট করার পর্যায়ে পড়বে না) এবং তার উপর ভিত্তি করে রুলিং বা ফতোয়াও ফকীহ্ ভেদে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু শরীয়াহর ঐ নিয়ম অর্থাৎ: “জীবন” নষ্ট করা চলবে না — সেটার কোন হেরফের হবার নয়।

এবার আসুন রাসূল (সা.)-এঁর আরেকটি হাদীসের প্রসঙ্গে, যেখানে তিনি বলেছেন যে, যেভাবে ইহুদীরা ৭১ ভাগে এবং খৃষ্টানরা ৭২ ভাগে বিভক্ত হয়েছিল, সেভাবে তাঁর উম্মাহ্ ৭৩ ভাগে বিভক্ত হবে। আরেক বর্ণনায়, মাটিতে কয়েকটি বাঁকা দাগ এবং মাঝখানে একটা সরলরেখা এঁকে তিনি বলেন যে, সেগুলোর মাঝে একটি, অর্থাৎ ঐ সরল রেখাটি হচ্ছে সঠিক — আর বাকীগুলো জাহান্নামমুখী। ঐ সরল রেখাকে তিনি তাঁর পথ বলে বর্ণনা করেন।

আল্লাহর ইচ্ছায় দৈবাৎ কোন পন্থায় ধরুন যদি আজ রাসূল (সা.)-এঁর কাছের সাহাবা যারা ছিলেন, তাদের — বিশেষত যারা দ্বীনের জ্ঞানে বিশেষভাবে জ্ঞানী ছিলেন, তাদের কাউকে নিয়ে এসে আমাদের এতদঞ্চলের মুসলিমদের জীবনযাত্রা দেখানো যেতো, তবে তাঁরা হয়তো প্রশ্ন করতেন, “এরা কোন দ্বীনের অনুসারী?” মাননীয় পাঠক! বিশ্বাস করুন আমি এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। বাংলাদেশের নিরিখে আমি বেশ কম বয়সে হজ্জ করেছি (আলহামদুলিল্লাহ্!) এবং তারও বেশ ক’বছর হয়ে গেলো। কিন্তু দ্বীন ইসলামের সত্যিকার রূপ কি? – রাসূল (সা.) বর্ণিত ৭২টি জাহান্নামমুখী পথের নিরিখে সত্যিকার সরলপথ এবং তাঁর পথ কোনটি? “আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা’আহ্”-এর পথ কোনটি? এই ব্যাপারগুলো মাত্র গত কয়েক বছর ধরে বুঝতে শুরু করেছি এবং বহুবারই এমন অনুভূতি নিজের হৃদয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে যে, আমার বিগত জীবনের সকল কর্মকাণ্ড, যেগুলোকে অত্যন্ত ভক্তিভরে, পুণ্য জ্ঞান করে বিশ্বস্ততার সাথে সমাধা করেছি, তার অধিকাংশই যোগ করলে, বিশাল এক ’অশ্ব-ডিম্ব’ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহর দয়ায় নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন আল্লাহ্, সে জন্য আশা করছি যে তিনি দয়া করে আমাকে মাফ করবেন এবং আমার এখনকার চেষ্টাকে কবুল করবেন — তা না হলে নামাজ, রোজা থেকে শুরু করে বিগত জীবনে ধর্ম-কর্ম পালন করতে গিয়ে যা কিছু করেছি, তার প্রতিটির পরতে পরতে ভ্রান্তি এবং “বিদ’আত” এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, জীবনের ষোল আনাই মিছে বলে মনে হবার কথা। আমি জানি আমার যেমন বোধোদয় হবার পরে প্রথম প্রথম মনে হতো যে, “আমার কিই বা করার ছিল? দেশে শত-সহস্র মাদ্রাসা থেকে প্রতি নিয়ত যে সব ‘আলেম’/’উলামা’ তৈরী হচ্ছেন, এসব তো তাদের দায়-দায়িত্ব। আমার পক্ষে কি এসব জানা সম্ভব ছিল?” আপনাকে আজ আমি যে সব বলছি, সে সব নিয়ে চিন্তা করতে বসলে হয়তো আপনারও তেমন মনে হবে, কিন্তু পাঠক! আমার মতই, আপনি যদি জীবনে শত শত বই পড়ে তবে একজন প্রকৌশলী, ডাক্তার বা আমলা হয়ে থাকেন – তাহলে কি আপনি এই অজুহাতে পার পাবেন যে, “আমার কি-ই বা করার ছিল? তারা আমাকে যে ’বিদ’আত’-পূর্ণ বাংলাদেশী ইসলাম, সিলেটি ইসলাম বা নোয়াখালী ইসলাম শিখিয়েছেন আমি তাই শিখেছি। পরীক্ষা পাসের পর হয়তো মিলাদ পড়িয়েছি। স্ত্রীর গর্ভধারণের জন্য হয়তো শাহপরানের মাজারে মানত করেছি, ভালো চাকুরীর জন্য হয়তো নারিন্দার পীর সাহেবের দ্বারস্থ হয়েছি, শাহ্ জালালের মাজারে গিয়েছি বিয়ের পর পর সস্ত্রীক পুণ্য অর্জন করতে এবং বে-আদবী হয় মনে করে উল্টো দিকে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করেছি, পুণ্য মৌসুমে হুজুর প্রতি তিন পারা হিসেবে একসাথে দশ জনকে গিয়ে 10x স্পীডে কুর’আন খতম করিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি”।

মাননীয় পাঠক! যে কোন শিক্ষিত মানুষ মাত্রেরই জানা উচিত যে, অতি সাম্প্রতিক কালের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, আমাদের দেশের মাদ্রাসাতে যারা পড়তে যান, তারা দেশের দরিদ্রতম অংশের সদস্য — অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভাব, রোগ-শোক ও অপুষ্টিজনিত কারণে, তাদের স্বাভাবিক কোন উপার্জনের যোগ্য করে তোলা অসম্ভব জ্ঞান করে, তাদের বাবা-মা তাদের মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। কখনো বা, ’অন্তত উপাস তো থাকবে না’ – এই যুক্তিটুকুই, ভর্তি করার চালিকা-শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গত কারণেই নকলের মহামারীর যুগে মাদ্রাসাসমূহের অবস্থা সাধারণ স্কুল কলেজের চেয়ে আরো করুণ হয়ে থাকে। আন্ডার ওয়্যারের ভিতরে কুর’আনের আয়াত বা হাদীসের পাতা ভরে নকলের ব্যবস্থা করতে একটুও প্রাণে বাধে না এসব হবু ইসলামজীবীদের। কয়েক বছর আগে পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটি ছবির কথা যতদিন বেঁচে থাকবো, ততোদিন মনে থাকবে বলে মনে হয় ইনশাল্লাহ্! ছবিটি আমাদের দেশের প্রগতিশীল একটি পত্রিকায় (খুব সম্ভবত প্রথম পাতায়, আর তা না হলে শেষ পাতায়) ছাপা হয়েছিল বিরাট আকারে। স্মার্ট ও ’ক্রিস্প’ সামার-সুট পরিহিত শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পা জড়িয়ে ধরে রয়েছেন বিশাল দাড়িওয়ালা জোব্বা পরা মাদ্রাসার দুই “হুজুর” সদৃশ ছাত্র। ছবিটি খুবই সিম্বলিক বলা যায় — পশ্চিমা সভ্যতার প্রতীক বলা যায়, এক সময়ের মার্কিন নাগরিক আমাদের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে — আর মধ্যযুগীয়, অশিক্ষিত, সেকেলে, জবুথবু বর্বর মুসলিম ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি যেন ঐ দুই মাদ্রাসা ছাত্র। তারা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর পা জড়িয়ে ধরে রয়েছেন, যাতে নকলে ধরা পড়ার অপরাধে তাদের যে বহিষ্কার করা হচ্ছে, তা যেন তিনি ক্ষমা করে দেন। ঘটনাটা সত্যি, আর তাই খবর হিসেবে যে কোন পত্রিকারই ঐ ছবিটি ছাপার অধিকার রয়েছে। তবু ঐ ছবিটি যেন “খবর+” একটা ব্যাপার ছিল। দেশের অধিকাংশ খবরের কাগজই – অন্তত প্রগতিশীলগুলো(!), সংস্কৃতমনা উদারপন্থী ইসলাম বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত – যারা গর্বভরে হুমায়ুন আজাদের ‘পাক-সার-জমিন-সাদ-বাদ’ বা তসলিমা নাসরিনের ’নষ্ট কলাম’ ছেপেছে। সুতরাং ইসলামজীবীদের হেয় প্রতিপন্ন করার এমন একটা সুযোগ আজ তারা হাত ছাড়া করবে কেন? তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু মাননীয় পাঠক! আপনি-আমি যারা এখনো নিশ্চিতভাবে আল্লাহ্, রাসূল (সা.), ফেরেশতা, কিতাবসমূহ, শেষ বিচার এবং অদৃষ্টে বিশ্বাস করি, তারা কি ভেবে দেখেছি যে আমরা আমাদের ঈমান/আকীদা সংক্রান্ত বিষয়াবলী কাদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছি এবং ভাবছি যে, ওরা যা বলবে তা করলেই তো চলে যাবে। এধরনের চরিত্রের লোকজন, যারা নকল করতে পারে এবং তার শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে আরেকজন মানুষের পায়ে ধরতে পারে, তাদের হেফাজতে আপনার এক জোড়া জুতা রাখাও তো সঙ্গত নয়, সে ক্ষেত্রে যে কোন মুসলিমের সবচেয়ে দামী যে সম্পদ “ঈমান” – তা কিভাবে আমরা এদের কথা-বার্তার variable বলে মেনে নিতে পারি — অর্থাৎ এরা মিলাদ পড়তে বললে আমরা পড়বো, এদের কথায় বাবা-মা মারা গেলে তাদের শ্রাদ্ধের আয়োজন করবো ৪ দিন বা ৪০ দিনের “সিন্নীর” নামে? ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং, আমরা যেভাবে শত শত বই পড়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি, তেমনিভাবে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার, সে ব্যাপারে যেন কেউ আমাদের বিপথে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ন্যূনতম জ্ঞান লাভ করার জন্য নিজেদের সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হলে, করবো ইনশা’আল্লাহ! ভেবে দেখবেন: ইসলামে (শিক্ষক, স্কলার বা ‘আলেমদের উচ্চ অবস্থান থাকলেও,) priesthood বা ‘ধর্ম-যাজকের’ কোন স্থান নেই বলে যে আমরা গর্ব করে বলে থাকি – অথবা, আমরা যেখানে বলতে পছন্দ করি যে, আমরা সরাসরি নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি এবং আমাদের কোন intercessor-এর বা ‘মধ্যবর্তী ব্যক্তির’ প্রয়োজন নেই – আজ সে কথাগুলো কেমন হাস্যকর বা অর্থহীন শোনাবে!! আমাদের অজ্ঞতার সুযোগে বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অচিরেই নিজের মুরগী জবাই করতে না জানার জন্য, হয়তো সে কাজের জন্যও আমাদের একজন ‘মোল্লা’ ডাকতে হবে (বিশেষত এই ব্রয়লার চিকেনের যুগে, যখন বাসায়/বাড়ীতে মুরগী জবাই করার পাট একপ্রকার চুকেই গেছে বলা যায় )। অথচ, আমাদের নিজেদের ধর্মীয় জ্ঞান এমন হওয়া বাঞ্ছণীয় ছিল যে, নিজের কুরবানীর পশু নিজেই জবাই করাতে পারার কথা, বাবা মারা গেলে নিজেই তাঁকে গোসল করানোর এবং তাঁর জানাজার নামাজ পড়ানোর কথা – সম্প্রদায়ের যে কোন একজন হাফিজ ভাইয়ের (অতি অবশ্যই বিনা পয়সায়) তারাবীর নামাজ পড়ানোর কথা। এভাবেই তাহলে, আমরা দ্বীন পরিত্যাগ করাতে আমাদের মাঝে বিশাল ইসলামজীবী একটা শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে – নিজেদের চূড়ান্ত জাহিলিয়াতবশত এমনকি তারা কি শেখাচ্ছেন আমাদের, তা ভেবে দেখারও বোধশক্তি হারিয়েছি আমরা – সত্যাসত্য জানার চেষ্টার কথা না হয় বাদই দিলাম। অথচ, নিরঙ্কুশ সত্য হচ্ছে, মুসলিমদের জন্য কেবল মাত্র একজন ব্যক্তি প্রশ্নের উর্ধ্বে — যিনি আমাদের প্রতি কোন আদেশ বা নির্দেশ দিয়ে থাকলে আমাদের জন্য তা প্রশ্নাতীতভাবে শিরোধার্য — আমরা সে আদেশের বা নির্দেশের মঙ্গলময়তা অনুধাবন করতে পারি বা না পারি – আর, তাঁর প্রতি এই আনুগত্যের দাবী রেখেছেন স্বয়ং আল্লাহ্ সুবাহানাহু তা’লা – সেই ব্যক্তি হচ্ছেন রাসূল (সা.)।

প্রথমত, আপনি যখন নিজেকে মুসলমান বলে ঘোষণা করছেন তখন যে ‘শাহাদা’ উচ্চারণ করছেন, সে শাহাদাতে আপনি সাক্ষী দিচ্ছেন যে মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বাণীবাহক রাসূল। সুতরাং আপনার ঈমানের সাথে, আপনার মুসলিমত্বের সাথে, সূচনালগ্ন থেকেই ঐ মহান ব্যক্তির সম্পৃক্ততা অপরিহার্য এবং অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয়ত, পবিত্র কুর’আনে বহু আয়াতে আল্লাহ্ আপনাকে প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিয়েছেন রাসূল(সা.)-কে মেনে চলতে – তাঁর আদেশ মেনে চলতে। আপনার হাতের কাছে পবিত্র কুর’আন থাকলে, তা টেনে নিয়ে পরখ করার জন্য আমি মাত্র কয়েকটি আয়াতের পরিচয় বলে দিচ্ছি – আপনি ৪:৪৯, ৫:৯২, ৮:১, ২৪:৫২, ২৪:৫৪, ২৪:৫৬, ৪৭:৩৩ — ইত্যাদির যে কোন একটি বা সব ক’টি দেখে নিন। এরপর সবচেয়ে কঠোরভাবে তাঁকে মেনে চলার কথা বলা হয়েছে মত একটা আয়াতের উদাহরণ দিচ্ছি, যেখানে আল্লাহ্ বলছেন যে, ‘কেউ রাসূল (সা.)-এঁর আদেশ যে মেনে চললো, তার অর্থ হচ্ছে সে আল্লাহরই আদেশ মানলো’। একথাটি পৃথিবীর একজন এবং কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির বেলায়ই প্রযোজ্য। ৪:৮০ আয়াতে আপনাকে আল্লাহ্ এই জ্ঞান দান করেছেন। আর কাউকে, এই মহাবিশ্বের কোন প্রাণীকে এই স্ট্যাটাস্ দেয়া হয়নি — আপনার পিতা-মাতা, ইমাম আবু হানিফা, মাও সেতুং, লেনিন, মৌলানা মৌদুদী, মৌলানা ইলিয়াস, দেওয়ানবাগী বা আপনার পাড়ার মসজিদের ৩ নং হুজুর – যিনি বাকী নামাজের পরে মিলাদের ঘোষণা দেন — কাউকেই নয়। সুতরাং মনে রাখবেন যে অমুক হুজুর বলেছেন বলে আপনি সারাজীবন বিদ’আতপূর্ণ কর্মকান্ডে ডুবে ছিলেন, একথা বলে আপনি শেষ বিচারের দিনে ‘পার পাবার’ কোন উপায় নেই — কারণ, কুর’আন বা সুন্নাহর কোথাও একথা বলা হয়নি যে, “অমুক” হুজুর আপনাকে যা খুশী তাই বলবেন, আর আপনি চতুষ্পদ জন্তু বা পালের ভেড়ার মত চলমান সগোত্রীয়দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবেন। হ্যাঁ, সিলেটের জয়ন্তিয়াপুরের দুর্গম এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র, নিরক্ষর বর্গাচাষী সুরমান আলী, যিনি তার ৩৫ বছরের জীবনে কখনো সিলেট শহরও দেখেননি, তিনি যদি তার স্ত্রীর বিলম্বিত প্রসব বেদনার জন্য মাইল দু’য়েক হেঁটে গিয়ে, (একটু আগে বলা) শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর পা জড়িয়ে ধরা ঐ দুই হুজুরের সমগোত্রীয় কোন হুজুরের কাছ থেকে দোয়া পড়া “ফুঁ” চোঙায় ভরে বা বোতলে করে ভরে নিয়ে এসে স্ত্রীর গায়ে ভক্তিভরে ঢেলে দেন, আল্লাহ্ তাকে তার নিরক্ষরতার জন্য ও অক্ষমতার জন্য ক্ষমা করলেও করতে পারেন। কিন্তু আপনি বা আমি যদি কোন হুজুরের কথায় অন্ধভাবে বিদ’আতপূর্ণ আচরণে নিজেদের নিমজ্জিত করি — কখনো সত্যাসত্য জানতে চেষ্টাও না করি — তবে আমাদের বেলায় আমরা কি আশা করতে পারি যে, আমরা অজ্ঞতার অজুহাতে পার পেয়ে যাবো? আমার তো মনে হয় তা হবার কোন সম্ভাবনা নেই — কারণ রাসূল (সা.)-এর মুখ থেকে মিথ্যা কথা নিঃসৃত হয়নি — এটা আমাদের একটা মৌলিক বিশ্বাস — আর তিনি তো ’খুতবাতুল হা’জায়’ বলেছেন “ওয়াকুল্লা বিদ্’আতীন দালালা, ওয়াকুল্লা দালালতীন ফিন্নার!”

করণীয়/বর্জনীয় – শেষ পর্ব

২১ শে নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:২৭
এবার আসুন তাহলে খুতবাতুল হা’জার দ্বিতীয় বা শেষ অংশের প্রসঙ্গে। ’খুতবাতুল হা’জার’ দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, “ইবাদতের প্রতিটি নতুন পন্থা হচ্ছে বিদ’আত বা নব্য-প্রথা, প্রতিটি নব্য-প্রথা হচ্ছে এক পথ-ভ্রষ্টতা বা বিচ্যুতি এবং প্রতিটি বিচ্যুতি (যে কাউকে) ভুল পথে পরিচালিত করে জাহান্নামের আগুনে নিয়ে যায়।” এই অত্যন্ত সারবান কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করতে হবে প্রতিটি বিশ্বস্ত মুসলিমের এবং সেগুলোকে জীবনে ধারণ করতে হবে। পাঠকের সুবিধার্থে আমি সংশ্লিষ্ট জ্ঞাতব্য বিষয়কে কতগুলি পয়েন্টে বিভক্ত করে লিপিবদ্ধ করছি :

১)আমাদের মনে রাখতে হবে যে পবিত্র কুর’আনের ৫:৩ আয়াত অনুযায়ী, আমাদের দ্বীন, মুহাম্মদ (সা.)-এঁর জীবদ্দশায়ই সম্পূর্ণ এবং নিখুঁত আঙ্গিক লাভ করেছে। এরপর যদি কেউ মনে করেন যে, নতুন করে সেখানে কিছু যোগ করার প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর ঐ ঘোষণাকে ভুল প্রতীয়মান করার চেষ্টা করার সমতুল্য।

২) রাসূল (সা.)-এঁর বক্তব্য অনুযায়ী মুসলিমরা বহুমতে ও অংশে বিভক্ত হবে — যার একটি মাত্র ঠিক, বাকীগুলো জাহান্নামমুখী। এখান থেকেই বোঝা যায় যে, ইসলামের কেবল একটি এবং একটি মাত্র রূপই সত্য — বাকীগুলো ভ্রান্ত। সেই সঠিক একটি রূপ কোনটি, সেটা যাচাই বাছাই করা প্রতিটি মুসলিমের — অন্তত যাকে আল্লাহ্ শিক্ষার আলো দান করেছেন, সেরকম প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য করণীয় কর্তব্য ও শিরোধার্য দায়িত্ব। আর কিছু নয় – কেবল নিজেকে আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যই তা প্রয়োজন।

৩) আখেরাতে বিশ্বাসী প্রতিটি মুসলিমের উচিত – অন্ধভাবে কোন মৌলবী, হুজুর বা নেতাকে অনুসরণ করার ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন ও সাবধান হওয়া। কারণ মানুষকে সারাজীবন ভুল পথে চলার প্ররোচনা দিয়েও, শেষ বিচারের দিনে শয়তান তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব যেমন অস্বীকার করবে (কুর’আন, ১৪:২২) — ঠিক একইভাবে আপনি কোন পথ বেছে নিলেন, তার দায়-দায়িত্ব কেউ বহন করবেন না কিয়ামতের দিনে। আপনি বলতে পারবেন না, ”আমার পাড়ার মসজিদের ৩নং হুজুরের আহ্বানে আমি ’মিলাদ’ পড়েছি” – যে কার্যটি, রাসূল(সা.)-এঁর ভাষ্যমতে সবচেয়ে সেরা মুসলিম যে তিন প্রজন্ম, তাঁদের কেউ কখনো সমাধা করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই।

৪) মনে রাখবেন রাসূল (সা.)-এঁর পবিত্র মুখের বক্তব্য অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ মুসলিম হচ্ছেন তাঁর প্রজন্ম, তারপর তার পরের প্রজন্ম এবং তারপর তার পরের প্রজন্ম। রাসূল (সা.)-এঁর মৃত্যুর ৭০ বছর পরে ইমাম আবু হানিফার (রহ.) জন্ম হয় এবং সেই সুবাদে আজকের হানাফী মায্হাবের উৎপত্তি। একইভাবে অন্যান্য মায্হাবের ইমামগণও রাসূল (সা.)-এঁর মৃত্যুর ৭০ বছরেরও বেশী সময় পরে জন্ম গ্রহণ করেন। মাযহাবভুক্ত হওয়া যদি ভালো মুসলিম হবার শর্ত হতো, তাহলে রাসূল (সা.)-এঁর মৃত্যুর পরবর্তী ৭০ বছরের মুসলিমদের অবস্থা ও অবস্থান কি দাঁড়ায়? হযরত ওমরের (রা.) মাযহাব কোনটা, হযরত আলীর (রা.)? অথবা ইবনে মাস্উদ (রা.) বা ইবনে ওমর (রা.) তাদেরই বা মাযহাব কোনটা? হ্যাঁ, অক্ষম ও নিরক্ষর ব্যক্তির উপায় নেই বলে, সে কোন মাযহাব অনুসরণ করতে পারে। আপনি বা আমিও জন্ম সূত্রে কোন না কোন মাযহাবভুক্ত — তাতে দোষের কিছু নেই। তবে যখনই আমরা অন্ধভাবে কোন বাছ-বিচার ছাড়া এবং কিছু জানার চেষ্টা ছাড়া কোন মাযহাব অনুসরণের করার চেষ্টা করবো, তখনই তাতে ঐ মাযহাবের ভ্রান্তিসমূহ এসে যুক্ত হবে। মনে রাখতে হবে মাযহাবের ইমামগণ নবী বা পয়গাম্বর তো ননই, এমনকি সাহাবাদের মত উচ্চ আসনেরও কেউ নন তারা – যাদের উপর আল্লাহ্ নিজে ’রাজী’ বা সন্তুষ্ট বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং তাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করার প্রশ্নই আসে না। যে কোন মাযহাবের যে কোন নিয়ম রাসূল (সা.)-এঁর বিশুদ্ধ কোন হাদীসের পরিপন্থী হলে, তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। সেজন্য শুদ্ধ হাদীসসমূহ যেমন জানতে হবে, তেমনি তোতা পাখির মত কুর’আন না পড়ে অর্থসহ কুর’আন পড়তে হবে এবং কুর’আনের আদেশ ও নিষেধসমূহ জীবনে ধারণ করতে হবে।

৫) বাপ-দাদার ঐতিহ্যের অন্ধ অনুসরণ, দ্বীনের ভ্রান্ত অনুশীলনের কোন যুক্তি হতে পারে না। রাসূল (সা.) মক্কায় কাফিরদের দ্বীনের দাওয়াত দিলে, তারাও এই যুক্তি দেখিয়েছিল যে, বাপ-দাদার ঐতিহ্য তারা কি করে ত্যাগ করবে! সুতরাং, কোন মুসলিম এই যুক্তিতে কোন বিদ’আত বা ভ্রান্ত কর্মকান্ড জীবনে ধারণ করতে পারেন না।

৬) আপনার সমাজ, সংসার ও জীবনে কোন কোন কর্মকান্ড বিদ্’আতের পর্যায়ে পড়ে – সেগুলোকে যথাশীঘ্র চিহ্নিত করে বর্জন করতে হবে। এ ব্যাপারে আপনার কষ্টিপাথর হবে কুর’আন ও সুন্নাহ। ইবাদতের ব্যাপারে কেবল ঐ সমস্ত কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করা যাবে, যেগুলো আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূল (সা.) নির্দিষ্টভাবে আপনাকে করতে বলেছেন বা আদেশ করেছেন — তার বাইরে প্রতিটি মনগড়া ও নতুন ভাবে উদ্ভাবিত ইবাদতের কাজই হচ্ছে বিদ্’আত – যা আপনাকে পূর্বে বর্ণিত খুৎবাতুল হা’জার দ্বিতীয় অংশ অনুযায়ী জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এবার ভাবুন, যে মিলাদ রাসূল (সা.) (বা আল্লাহ্) আপনাকে পড়তে বলেন নি, রাসূল (সা.) -এঁর মৃত্যুর পর ৫০০ বছর পর পর্যন্ত যার কোন অস্তিত্ব ছিল না — সেই মিলাদকে পুণ্যময় কাজ মনে করা কত গর্হিত একটা বিষয় এবং কত বড় বিদ্’আত বা “নব্য-প্রথা”। এভাবে আপনি একটু জানতে চেষ্টা করলেই দেখবেন যে, আমরা কিরকম আকণ্ঠ বিদ্’আতে ডুবে আছি। বহু মানুষ বা অধিকাংশ মানুষ একটা পন্থা অবলম্বন করছে, এটা দ্বীনের ব্যাপারে বিশুদ্ধতা প্রমাণের কোন মানদন্ড হতে পারে না। ইসলাম কোন গণতন্ত্রের বিষয় নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বল্লেই একটা ভুল ব্যাপারও শুদ্ধ হয়ে যাবে – বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার উল্টো ব্যাপারই ঘটে থাকে। সারা পৃথিবী জুড়ে সুদ বৈধ এবং পৃথিবীর ৯৯% মানুষই হয়তো সুদকে সঠিক মনে করে – কিন্তু তাই বলে ইসলাম কখনোই সুদকে সঠিক বলে মেনে নিতে পারে না।

পাঠক আপনাকে আরো দু’টো তথ্য দেই। মিলাদের উৎপত্তি শিয়াদের কাছ থেকে এবং “মিলাদ” অর্থ হচ্ছে জন্মদিন। আপনার বাবা মারা গেলে আপনি রাসূল (সা.)-এর জন্মদিন পালন করবেন — এই ব্যাপারটার কোন যুক্তি থাকতে পারে? ভেবে দেখুন।

৭) ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে বেশী বেশী করে সিরাহ্ ও হাদীস পড়ূন। আপনি যদি জানতেন যে, এক বিঘতের চেয়ে উঁচু মদীনার সকল কবর মিশিয়ে ফেলতে রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে রীতিমত মিশনে পাঠিয়েছিলেন, তাহলে লালসালু ঢাকা কবরের পূজা কখনোই করতে পারতেন না বরং কবরের উপর যে কোন নির্মাণ যে পরিত্যাজ্য, তা মেনে চলার চেষ্টা করতেন।

৮) সময়ের সাথে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে — জীবন যাত্রার মানের এবং ধরণের পরিবর্তন এসেছে — এগুলো জাগতিক পরিবর্তন। যেমন ধরুন রাসূল (সা.) উটে চড়েছেন – আপনি আজ প্লেনে চড়ছেন — তাহলে কি প্লেনে চড়া বিদ’আত? না! নিশ্চয়ই নয়!! মনে রাখতে হবে — আবারো, খুতবাতুল হা’জার বর্ণনায় “বিদ’আত” কথাটা এসেছে উপাসনার বা ইবাদতের প্রসঙ্গে — আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রসঙ্গে। সুতরাং ইবাদতের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ব্যাপারের সংযোজনকে কেবল আমরা বিদ্’আত বলবো। উদাহরণ স্বরূপ মধ্যপ্রাচ্যে এমন অনেক তথাকথিত পীর-বুজুর্গের কবর রয়েছে, যে গুলোর চারিদিকে ভক্তকুল “তওয়াফ” করে থাকেন — এসব ব্যাপার যে কেবল বিদ্’আত তাই নয় — শিরকও বটে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও, আমাদের বাংলাদেশী ইসলামকে বিদ’আত থেকে আলাদা করা – অনেকটা রান্না করা তরকারী থেকে বিভিন্ন মশলাকে আলাদা করার মতই কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখবেন আল্লাহ্ এক এবং তাঁর শেষ নবীও একজন একক ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃপক্ষ (authority) – সুতরাং ইসলামের একটাই রূপ হবার কথা। সামাজিক পর্যায়ে বিদ’আত পরিত্যাগের চেষ্টা করার আগে, সচেতন ব্যক্তিদের উচিত, ব্যক্তিগত জীবন থেকে বিদ্’আতের আবর্জনা সাফ করা। আমি জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে চাই না এবং নিজেকে সর্বাগ্রে সে আগুন থেকে বাঁচাতে চাই — তারপর নিজের নিকটাত্মীয় এবং তারপর সমাজকে বাঁচানোর কথা আসছে। সমাজ জাহান্নামমুখী বলে, আমাকে জাহান্নামে যেতে হবে এমন কোন কথা নেই। অনেক নবী-পয়গাম্বর ছিলেন যাদের একজনও অনুসারী ছিল না — তাদের গোটা জনগোষ্ঠী নিশ্চিত জাহান্নামী, তবু ঐ জনগোষ্ঠীর মাঝে থেকেও ঐ সব নবী-পয়গাম্বর একাই সত্যের ঘোষণা এবং অনুশীলন করে গিয়েছেন এবং তাতে ‘সত্য’ মিথ্যা হয়ে যায়নি।

আগে যেমন বলেছি, আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.) বা কুর’আন ও সুন্নাহ্ হবে আপনার কষ্টিপাথর। রাসূল (সা.) যে তিন প্রজন্মকে শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করে গেছেন — সেই তিন প্রজন্মের মাঝে দ্বীন সম্বন্ধে যে সব জ্ঞান, ধারণা ও অনুশীলন প্রচলিত ছিল — আমাদের সে সবে ফিরে যেতে হবে – পরবর্তীতে আবিষ্কৃত সকল “নতুন-পন্থা” তথা “নব্য-প্রথা” বা “বিদ্’আত” পরিত্যাগ করে।

আমাদের বাংলাদেশী ইসলামের A to Z বিদ্’আতে ভরা। আপনি একটু পড়া-শোনা করলেই বুঝবেন — অথচ এসব বলা যাদের দায়িত্ব ছিল, তারা হয় জীবিকার ভয়ে অথবা জীবনের ভয়ে না হয় জ্ঞানের অভাবে মুখে কুলুপ এঁটে জীবন পার করে দিচ্ছেন। হয়তো, গ্যালিলিওর ভাগ্য যাতে বরণ করতে না হয় – অথবা প্রস্তর নিক্ষেপে যাতে জীবনাবসান না ঘটে, সে জন্য তাদের ঐ সাবধানতা। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় “কবে আর হবে থাকিতে জীবন”? কাউকে তো ভুলকে ‘ভুল’ বলতে হবে, মিথ্যাকে ‘মিথ্যা’ বলতে হবে!! ফিত্না এড়িয়ে চলা এবং প্রাণ বাঁচানোর যুক্তি হয়তো এখানে প্রকট। কিন্তু জেনেশুনে দ্বীনের ব্যাপারে সত্য গোপনকারীরা – বিশেষত দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানীরা – যে কঠোর পরিণতির সম্মুখীন হবেন, এমন একটা ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দেয়া যায়? আল্লাহু ‘আলাম! সত্য জানা আলেমরা যদি সত্য ঘোষণা না করেন, তবে কারা সে দায়িত্ব পালন করবে? আমার মত মিস্ত্রীরা??

যাহোক্, আসুন দৈনন্দিন জীবনের কয়েকটি বিদ্’আতের কথা আমিই আপনাকে বলি। আমার মত নালায়েক বান্দার কথায় আপনি ঝাঁপ দেবেন, আমি নিজেও সেটা চাই না। আমি কেবল চাই, আপনি ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবুন এবং জানতে চেষ্টা করুন – ঠিক যেমন আল্লাহর দয়ায় আমি জেনেছি।

নামাজের “ছক-বাঁধা” নিয়ত কত কম বয়সে মুখস্থ করেছি, আজ আর তা মনেও করতে পারি না — আপনার বেলায়ও হয়তো তাই প্রযোজ্য। আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়া আছেন যিনি নামাজের ঐ নির্দিষ্ট নিয়ত পড়তে গিয়ে ভুল হচ্ছে ভেবে, শুধু নিয়ত করতে গিয়েই প্রতি নামাজের শুরুতে (বার বার নতুন করে ভুল শুদ্ধ করে নিয়ত করতে করতে) কয়েক মিনিট সময় নষ্ট করেন — তাকে যারা চেনেন, তাদের অনেকেই তাকে মানসিক বিকারগ্রস্থ মনে করেন। অথচ পুরা ব্যাপরটাই বাহুল্য — কোন নির্দিষ্ট বুলি আউড়ে নিয়ত করাটা হচ্ছে বিদ্’আত। রাসূল (সা.) বা তাঁর সাহাবীরা কখনোই এমন করেন নি। কোন ওয়াক্তের কি নামাজের জন্য আপনি দাঁড়াচ্ছেন, এটা মনে করা বা আপনার মনে থাকাই যথেষ্ট — এর পর ”আল্লাহু আকবর” অর্থাৎ তাকবীর তাহরিমা সহকারে নামাজ শুরু করা যথেষ্ট।

এর পর আসুন মসজিদে ফরজ নামাজের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশী মসজিদে ফরজ নামাজ শেষে সবাই বসে থাকেন “জামাতে” দোয়া পড়ার জন্যে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই এই দোয়াকে নামাজের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ মনে করা হয়। আপনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত ইচ্ছা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারেন হাত তুলে বা না তুলে। কিন্তু প্রতি ফরজ নামাজের পরে “ইবাদত” জেনে, ইমাম সাহেবের সাথে “আল্লাহুম্মা আমীন” বলে হাত তুলে দোয়া করাটা এক “নির্ভেজাল” বিদ্’আত — যা রাসূল(সা.) কখনো করেন নি। হ্যাঁ, বিশেষ উপলক্ষে তিনি নামাজ শেষে সমবেত সকলকে নিয়ে দোয়ার জন্য হাত উঠিয়েছেন — যেমন ধরুন ইস্তেসকার নামাজের শেষে বৃষ্টির জন্য। কিন্তু প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের শেষে জামাতে দোয়া করার কোন দলিল নেই!!

মালার গুটি টিপে টিপে তসবিহ্ জপা, কেউ মারা গেলে মৃত্যুর ৪ দিন পরে বা ৪০ দিন পরে লোক খাওয়ানোর আয়োজন বা কুর’আন খতম দেয়া এবং সেই খতমের হাসিলকৃত সওয়াব মৃতের একাউন্টে ট্র্যান্সফার করা ইত্যাদি হচ্ছে খুব সাধারণ কিছু প্রচলিত বিদ্’আত।

মাননীয় পাঠক! আবারো বলছি – আমি শুধু আপনাকে কিছু তথ্য দিলাম। আপনি জাহান্নামমুখী ৭২ টি পথের একটিতে রয়েছেন, নাকি সম্ভাব্য সুসংবাদ প্রাপ্ত একমাত্র পথটিতে রয়েছেন – একথা না জেনেই অথবা জানার কোন চেষ্টা না করেই কি আপনি কবরে যেতে চান? আখেরাতে বিশ্বাসী কারো কি সেই দুঃসাহস হবার কথা?? আপনিই বলুন!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *