ইসলামে আধুনিকতাবাদ
ইসলামে আধুনিকতাবাদ -১
আস সালামু আলাইকুম
মূল: জামাল-আল-দীন জারাবযো
আধুনিকতাবাদ কি এবং এর উৎপত্তি
সমকালীন “আধুনিকতাবাদী আন্দোলন” [বা Modernist Movement’’] যে দশর্নের অনুসারী, সেই দর্শন আমাদের হিজরী ৩য় শতাব্দীর একটি গোষ্ঠীর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই গোষ্ঠীর নাম: মু’তাযিলা। যদিও তারা কুর’আন ও সুন্নাহকে অস্বীকার করত না – কিন্তু তারা তাওইল করত – আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবারা যেভাবে কুর’আনরে ব্যাখ্যা দিয়েছেনে তা বাদ দিয়ে নিজের বিচার–বুদ্ধি অনুযায়ী কুরআ’নরে ব্যাখ্যা দিত (অর্থাৎ কুর’আনের মনগড়া ব্যাখ্যা দিত) । তারা না’কল (text বা রাসূল (সা.)-এঁর দিক-নির্দেশনা ) অপেক্ষা ‘আক্বল(reason – নিজ বুদ্ধমিত্তা)-এর প্রাধান্য দিত। কালের পরিক্রমায় এই গোষ্ঠীর বিলুপ্তি ঘটেছে।
সেই ‘‘মু’তাযিলা’’ গোষ্ঠীর সাথে হালের মুসলিম বিশ্বের “আধুনিকতাবাদী আন্দোলন”-এর কোন প্রত্যক্ষ যোগসাজস না থাকলেও, তাদের চিন্তাধারা ও আদর্শে মিল পাওয়া যায়। এমনিতে “আধুনিকতাবাদী আন্দোলন”-এর সূচনা হয় ইউরোপে। সে সময় স্পেনে বিজ্ঞানচর্চার রেনেসাঁ চলছিল। দেখা গেল এতদিন ধরে চার্চ যেসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করছে, তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই। তাই মানুষের মাঝে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগল। তারা ধর্ম থেকে দূরে সরে যেতে লাগল।
এই ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যই আধুনিকতাবাদের উৎপত্তি হলো। ধর্ম সম্বন্ধে আধুনিকতাবাদের মূল কথা হলো – ‘‘ধ্রুব–সত্য (বা absolute truth) বলে কিছু নেই। তাই ধর্মও কোন অপরিবর্তনীয় জিনিস নয়। বরং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ধর্মকে আরো পরিশোধন, পরিমার্জন করা প্রয়োজন’’। তাই ইহুদি ও খ্র্রিস্টান আধুনিকতাবাদীরা তাদের ধর্মকে আরো আধুনিক করার চেষ্টা করলো এবং নতুন নতুন আচার-অনুষ্ঠানের সূচনা করল। উদাহরণস্বরূপ ১৯০০ সালের দিকে প্রথম চার্চে গান- বাজনার সূচনা হয়। এভাবে ধর্মে নতুন নতুন অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করে তারা মানুষকে আবার ধর্মমুখী করার চেষ্টা করল। তারা বলল: ‘‘যেহেতু বাইবেলে স্রষ্টা এবং মানুষ উভয়ের কথাই স্থান পেয়েছে, তাই বাইবেলে কোন পরম সত্য (absolute truth) নেই। আর বাইবেলের ততটুকুই সত্য, যতটুকু যুগের সাথে তাল মেলাতে সক্ষম’’।
দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিমরা ইউরোপীয়দের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। সুতরাং মুসলিমদের সামনে তিনটি রাস্তা খোলা ছিল:
(১) ইউরোপীয়দের ন্যায় ধর্মবিমুখ জীবন যাপন করা
(২) পুরোপুরি সত্য–ধর্ম ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করা
(৩) ইসলাম ধর্মের আধুনিকীকরণ করে তার নতুন রূপ দেয়া এবং এই পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত আধুনিক ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করা।
যারা তৃতীয় রাস্তাটি বেছে নিয়েছিলেন তারাই [Islamic Modernism-এর বা] “ইসলামী আধুনিকতাবাদের” সূচনা করেন। প্রধানত তুরস্ক (তুরস্ক তখন ব্রিটিশদের কর্তৃত্বাধীন) ও মিশরে (যেহেতু আল-আযহার তখন ইসলামী শিক্ষার মূলকেন্দ্র ছিল) এই ইসলামী আধুনিকতাবাদের সূচনা হয়। এরা ইসলামের সকল বিধি-নিষেধকে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দ্বারা বিচার করা শুরু করল। আধুনিকতাবাদীদের এই চিন্তা-চেতনার ত্রুটিগুলো নিম্নরূপ:
(১) সবকিছু নিজেদের বিবেক–বুদ্ধি দ্বারা বিবেচনা করে।
(২) নিজেদের বিবেক–বুদ্ধির সাথে কোন দর্শন মিলে গেলে তারা তা অনুসরণ করে। অন্যথায় তা পরিত্যাগ করে ।
(৩) সকল ওহী (Revelation) তারা “‘আক্বল” দ্বারা বিচার করে – নিজেদের ‘আক্বলের সাথে না মিললে তারা ওহীকে প্রত্যাখ্যান করে।
অথচ, “আহলুস সুন্নাহ ওয়া আল-জামা‘আহ” ঠিক বিপরীত মত পোষণ করে। আহলে সুন্নাহ ওয়া আল জামা‘আর মতে, কোন ব্যক্তি যদি সঠিকভাবে তার ‘আক্বল ব্যবহার করে, তবে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, কুর’আনই হলো [absolute truth বা] নিরঙ্কুশ সত্য এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। সঠিক আক্বলের অভাবে কোন ব্যক্তি এই সিদ্ধান্তে উপনীত নাও হতে পারে। তাই কুর’আন ও সুন্নাহকে আমাদের ‘আক্বলের উপর প্রাধান্য দিতে হবে।
আমেরিকায় আধুনিকতাবাদের প্রভাব
[মুসলিম] আধুনিকতাবাদীরা বলে, পশ্চিমা জগত তথা গোটা বিশ্বে আজ আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মকে তাই পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলাতে আরও সভ্য হতে হবে। আধুনিকতাবাদীদের এই ধারণা আজ গোটা আমেরিকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে, কারণ:
(১) হয়তোবা আধুনিকতাবাদীদের যুক্তি খন্ডন করার মত ‘আলেম নেই –অথবা– থাকলেও তারা তা করতে পারছেন না, কারণ সাধারণ জনগণ আধুনিকতাবাদীদের পক্ষে।
(২) এর দ্বারা অন্যান্য দেশের মুসলিমরা খুব সহজেই আমেরিকান সমাজের সাথে একাত্ম হতে পারে। তাদেরকে মুসলিম হিসেবে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। এমনকি নব্য আমেরিকান মুসলিমদেরকে তাদের পূর্বের জীবনের অনেক অনৈসলামিক কাজ বা আচরণও ত্যাগ করতে হয় না।
(৩) আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের সাহিত্য ও গুণীজনেরাও এই মতবাদকে সমর্থন করে।
ইউসুফ আলীর তাফসীর আমেরিকায় খুব জনপ্রিয়, যদিও তিনি ‘আক্বলকে নাকলের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। আমেরিকায় প্রচলিত সীরাত [রাসূল (সা.)-এঁর জীবনী] গ্রন্থগুলোও এখানে উল্লেখযোগ্য: আধুনিকতাবাদীদের কোন গ্রন্থে রাসূল (সা.)-এঁর মর্যাদাকে সাধারণ মানুষের সমান বলা হয়েছে। আবার কোন গ্রন্থে বলা হচ্ছে যে, সুন্নাহ্ থেকে শরীয়াহর কোন বিধি-নিষেধ আসতে পারে না এবং অনেক ক্ষেত্রে হাদীসও উপেক্ষা করা যায় – কারণ রাসূল (সা.) যখন কোন ইজতিহাদ করছেন, তখন আল্লাহ্ তার ভুল শুধরে দেননি [নাউযুবিল্লাহ্]।
ফিকাহ শাস্ত্র্রেও আধুনিকতাবাদীরা অনেক দূর এগিয়েছে। তারা সুদকে হালাল করেছে। তাদের মতে, রজঃস্রাব অবস্থায় মেয়েরা সালাত আদায় করতে পারে। মুসলিম মহিলা আজ কাফির পুরুষকে বিয়ে করতে পারে। তারা বলে যে, রাসূল (সা.)-এঁর মৃত্যুর ১৫০ বছর পর মেয়েদের মুখ ঢাকার প্রচলন হয়েছে [বাস্তবে রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায়ই এর প্রচলন ছিল], মেয়েদের সর্বদা মসজিদে সালাত আদায় করা উচিত (যদিও হাদীসে মেয়েদের ফজর ও ইশা’র সালাতের বর্ণনা পাওয়া যায়, কারণ এই দুই সময়ে তাদের সহজে চেনা যাবে না)। তারা আরও বলে যে, “নারী নেতৃত্বাধীন কোন জাতি উন্নতি করতে পারবে না” – এই হাদীসটিও বর্তমানে অচল। তারা বলে যে, সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যতীত বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই আধুনিকতাবাদীরা আজ অনেক বেশী প্রভাবশালী ও সক্রিয়। আর তাদের কাজে সমর্থন যোগাচ্ছে আমেরিকান পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সভা-সমিতি ও সাহিত্যকর্ম।
[চলবে………. ইনশা’আল্লাহ্!]
ইসলামে আধুনিকতাবাদ – ২
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আস সালামু আলাইকুম
মূল: জামাল-আল-দীন জারাবযো
পূর্ব প্রকাশিতের পর…….আগের লেখাটা রয়েছে এখানে: www.sonarbangladesh.com/blog/muslim55/10109
ইসলাম সম্পর্কে আধুনিকতাবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি
আধুনিকতাবাদীদের চিন্তাধারা খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষেরা তাদের চিন্তাধারার ধারক, বাহক ও প্রচারক হয়ে ওঠে। অথচ তাদের চিন্তাধারা, দর্শনে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। যেমন:
(১) তারা ‘আক্বীদা সংক্রান্ত আলোচনা এড়িয়ে চলে। কারণ এটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
(২) তারা রাসূল (সা.)-এঁর বিভিন্ন সুন্নাহকে এড়িয়ে চলতে চায়। তাদের কাছে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা অনেক সহীহ হাদীসকেও অস্বীকার করতে পিছপা হয় না। তারা পূর্ববর্তী আলেমদের ইজমা থেকে কিছু গ্রহণ করতে চায় না। এভাবে তারা শুধু পূর্ববর্তী আলেম, মুহাদ্দিসদের ভুল ধরেই যায়, অথচ হাদীস বিশ্লেষণের কোন নতুন পথ দেখাতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, রাসূল (সা.) স্বয়ং আল্লাহ্ পাক কর্তৃক দিকনির্দেশনা পেতেন। সুতরাং রাসূল (সা.)-এঁর কোন সুন্নাহ্ আমাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হলেও, বাস্তবে তা অযৌক্তিক নয়। বরং জ্ঞানের স্বল্পতাই বাস্তব সত্যকে আমাদের কাছে অযৌক্তিক করে তোলে।
(৩) তারা শরীয়াহর বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সুন্নাহর প্রভাব মানতে নারাজ। তাদের কাছে রাসূল (সা.)-এঁর সুন্নাহ্ এবং দ্বীন আলাদা অর্থ বহন করে। সুন্নাহ্ আপনি মানতে পারেন, নাও মানতে পারেন। আপনি সুন্নাহ্ পরিবর্তনও করতে পারেন। আবার অনেকে বলে সময়ের পরিক্রমায় রাসূল (সা.)-এঁর সব সুন্নাহ্ যুগোপযোগী নয়। তাই যে সব সুন্নাহ্ যুগোপযোগী, কেবল সেগুলোই পালন করা যেতে পারে।
(৪) তাদের মতে প্রত্যেকই নিজস্ব ‘আক্বল অনুযায়ী ইজতিহাদ করতে পারে।
ইসলাম সম্পর্কে আধুনিকতাবাদীদের উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি, সুন্নাহকে দুর্বল করার ও গুরুত্বহীন বলে প্রতীয়মান করার প্রয়াস। ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও [তাদের নিজ নিজ ধর্মের বেলায়] ঠিক একই কাজ করেছিল – তারাও প্রেরিত পুরুষদের অতীন্দ্রিয় ও মানবীয় গুণাবলীকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা করেছিল। মুসলিম আধুনিকতাবাদীরা আল্লাহর নবী হিসেবে রাসূল (সা.)-এঁর যে সত্তা এবং কেবলি একজন মানুষ হিসেবে তাঁর যে সত্তা – এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করার চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে তারা এই ভেবে সুন্নাহর একাংশকে অস্বীকার করে যে, তা আল্লাহ্ প্রদত্ত কোন বিধান নয় বরং রাসূল (সা.)-এঁর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ।
আধুনিকতাবাদীরা কিভাবে বিপথগামী হয়
১) [মুসলিম] আধুনিকতাবাদীরা যেসব যুক্তিতর্ক ও অনুমানের ভিত্তিতে ইসলাম ধর্মকে দেখে থাকে, তা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সর্বদা পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায় এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে ইসলামকে ব্যাখ্যা করতে চায়। তাদের মতে:
(ক)সময়ের আবর্তনে সবকিছুই পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সেই যুগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে “মানুষ ততই সভ্য ও উন্নত হচ্ছে।’’ তাদের এই চিন্তাধারা নাস্তিক মার্ক্স ও হেগেলের চিন্তাধারার প্রতিফলন। অথচ রাসূল (সা.) ঠিক বিপরীত কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রতিটি প্রজন্মই নিকৃষ্টতর হচ্ছে (সহীহ)।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটা সমাজকে আমরা তখনই উন্নত বা সভ্য বলব, যখন মানুষের মাঝে তাকওয়া (বা আল্লাহ্-ভীতি) বিরাজ করবে। সেই সভ্য সমাজের সর্বত্র ইসলামিক জ্ঞানের চর্চা থাকবে এবং বাস্তব প্রয়োগ থাকবে। কিন্তু বর্তমানে সমাজে খুন, ধর্ষণ, অশ্লীলতা, সমকামিতা চরম আকার ধারণ করেছে। তাই আধুনিকতাবাদীরা সভ্য বলতে কি বোঝেন তা আগে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন।
(খ) স্থান, কাল ভেদে ধর্ম পরিবর্তন হতে পারে, তাই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ইসলামকে বিচার করতে হবে। তারা বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়েই ইসলামকে ব্যাখ্যা করে। তারা ভাবে যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়েই পশ্চিমারা আজ এতদূর এগিয়েছে।
অথচ আধুনিকতাবাদীরা বোঝে না যে, বিজ্ঞানের সব কিছুর পেছনে সত্য (fact) নিহিত নয়, বরং প্রস্তাবনা (অর্থাৎ অনুমান বা Hypothesis) নিহিত ।
(গ) আধুনিকতাবাদীদের মতে, সমাজ গঠনের পেছনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে। যেহেতু ধর্ম গঠনের পেছনে সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রভাবই মুখ্য, তাই সেই যুগের হাদীসগুলো এই যুগে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। আধুনিকতাবাদীদের কাছে ধর্ম হলো একটি আপেক্ষিক (Relative) ব্যাপার, পরম সত্য (বা Absolute Truth) কিছু নয়।
আধুনিকতাবাদীদের এই দাবীর পেছনে কোন প্রমাণ নেই। আল্লাহ্ বলেছেন: “কুর’আন হলো হক বা সত্য।’’
২) আধুনিকতাবাদীরা যে পদ্ধতিতে ইসলামকে বিশ্লেষণ করে বা ইসলামের ব্যাখ্যা দেয় তা ভুল। তারা নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক দাবি করে অথচ তাদের বিশ্বাসেরই কোন ভিত্তি নাই। তারা নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে:
(ক) তাদের মতে শুধু কুর’আন শরীফই সহীহ। হাদীসকে তারা নিজেদের ‘আক্বল [বা intelligence] দ্বারা বিচার করেন। যেমন সহীহ হাদিসে আছে: ‘‘নারী নেতৃত্বাধীন কোন জাতি উন্নতি সাধন করতে পারবে না”। আধুনিকতাবাদীরা এ ক্ষেত্রে ব্রিটেন (মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বধীন ছিল), ভারত, জার্মানী প্রভৃতি দেশের উদাহরণ টেনে বলে যে, এসব দেশ উন্নতি সাধন করছে। সুতরাং এই হাদীসটি সহীহ নয়। যেসব হাদীসে সুনির্দিষ্টভাবে (specific meaning) কিছু বলা হয়, সেসব হাদীস তারা অপছন্দ করেন। পক্ষান্তরে যেসব হাদীসে সাধারণ অর্থে কিছু বলা হয়েছে, তারা সেসব পছন্দ করেন।
(খ) ইসলামের ২টি বিশেষ ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদীরা পরিবর্তন চায়:
i) সুন্নাহর মর্যাদা।
ii) নারীর অধিকার।
তারা এই দুটি ব্যাপারে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করতে – সহীহ নয় এমন হাদীসের বর্ণনা করতে পিছপা হয় না। যেমন নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে তারা ২টি ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়:
#হযরত উমর (রা.) খুতবা দেয়ার সময় মোহরানার অর্থের একটা নির্দিষ্ট উচ্চ সীমা বেঁধে দিলেন। একজন মহিলা তখন প্রতিবাদ করলেন এবং হযরত উমর (রা.) এর বিরুদ্ধে কথা বললেন। হযরত উমর (রা.) তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং ঐ মহিলাকে ধন্যবাদ জানালেন।
## হযরত উমর (রা.) উম্মে সাফিয়াকে বাজার নিয়ন্ত্রকের পদে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
এই দুটি ঘটনা দ্বারা আধুনিকতাবাদীরা নারীর অধিকার বৃদ্ধি করতে চায় এবং নারীদের ঘরের বাইরের কাজে উদ্ধুদ্ধ করতে চায়। অথচ এই ঘটনা দুটি সহীহ্ [হাদীসে বর্ণিত] নয় বা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে উদ্ভূত নয়।
গ) তারা বিভিন্ন অস্পষ্ট বা ভাসাভাসা শব্দাবলী (vague terms) ব্যবহার করে যেমন: গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সমতা ইত্যাদি ৷ কিন্তু এসব শব্দের কোন সুস্পষ্ট অর্থ বলে না ৷ জ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা তাদের এই কথার মারপ্যাঁচ বুঝতে পারলেও, সাধারণ মানুষ এসব দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে যায় ৷ তারা ভাবতে শুরু করে যে, গণতন্ত্র আর ইসলামের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, নারী ও পুরুষ সমান ৷
ঘ) কোন বিষয় সম্পর্কে কুর’আন ও সুন্নাহ্য় পূর্ণাঙ্গভাবে কি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷ বরং তাদের নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব আয়াত বা হাদীস প্রয়োজন তারা কেবল সেসবই উপস্থাপন করে ৷
ঙ) আধুনিকতাবাদীরা [তাদের] ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয় ৷ মু’তাযিলারা ঠিক তেমনটাই করেছিল যখন তারা ‘আক্বলকে রাসূল (সা.)-এঁর হাদীস বা সুন্নাহ্র উপর প্রাধান্য দিয়েছিল ৷ অনেক আধুনিকতাবাদীরা বলে যে, “ইসলাম একটি যৌক্তিক ধর্ম ৷ সুতরাং নিজের বিবেক বুদ্ধিতে যেসব ইসলামী বিধি–বিধান সঙ্গত মনে হয় বা ভাল লাগে, শুধু সেগুলোই পালন করব”৷
আধুনিকতাবাদীদের এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল ৷ আধুনিকতাবাদীরা যৌক্তিক বা বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন [rational] বলতে যা বোঝাতে চান তা ঠিক নয় ৷ বরং ইসলাম এই অর্থে একটি যৌক্তিক ধর্ম যে, ইসলামে কোন পরস্পরবিরোধিতা নেই ৷ কিন্তু আমরা কেবল আমাদের বুদ্ধিমত্তার জোরে ইসলামের সবকিছুই জানতে পারি – এমন ঘোষণা দেয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা এর সপক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ নেই ৷ কুর’আন এবং সুন্নাহ্কে জীবনে বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতে গিয়ে আধুনিকতাবাদীরা বলে যে, আমাদের মাঝে ইসলামী হৃদয়ানুভূতি থাকা উচিত এবং আমাদের উচিত সুনির্দিষ্ট শরীয়াহ্ আইন-কানুন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং ইসলামী ধ্যান-ধারণা অনুসরণ করে চলা ৷ কিন্তু কুর’আন ও সুন্নাহ্ থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের জীবনে দু’টোই ধারণ করতে হবে [অর্থাৎ, হৃদয়ানুভূতি এবং আইন-কানুন দু’টোই] ৷
তারা তর্ক জুড়ে দেবে যে, কুর’আনে নারীদের সংযত পোশাক পরিধান করতে বলা হয়েছে, কিন্তু তারা হিজাব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা করতে চায় না ৷ তারা বলে সংযত আচরণের বিষয়টা অন্তরে থাকাই জরুরী, যতটা না হিজাব করা প্রয়োজন ৷ অথচ আমরা কুর’আন ও সুন্নাহ্ থেকে স্পষ্ট জানতে পারি যে, অন্তরে এবং কাজে উভয়েত্রেই ইসলামের প্রয়োগ প্রয়োজন ৷
চ)তাদের মাঝে স্কলারদের বিরোধিতা করার প্রবণতা রয়েছে ৷ “স্কলাররা [প্রচলিত ধারণার বিপরীতে] অন্য কিছু বলতে চেয়েছেন” – এমনটা বলে তারা তাদের বিরোধিতা করে থাকে ৷ তারা বলে ইজতিহাদের দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে – যা ‘আহলুস সুন্নাহ্ ওয়া আল জামা‘আহ্র’ মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ৷ কিন্তু তা যে কারো জন্য, যে কোন বিষয়ের ব্যাপারে উন্মুক্ত নয় ৷ তাদের মতে যে কোন ব্যক্তিই ইজতিহাদ করতে পারে ৷ এর জন্য কোন সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার প্রয়োজন নেই ৷ বহুবিবাহ প্রথা ও তালাক প্রথা ইজতিহাদের মাধ্যমে রদ করা যায় – এই মর্মে আধুনিকতাবাদীদের ঘোষণা একটি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে ৷ তারা প্রায়ই স্কলারদের ভুল ভাবে উদ্ধৃত করে থাকে এবং তাঁরা যা বলেছেন সে ব্যাপারে নিজস্ব অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে ৷
ছ) তারা নিজেদের মতামত সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সহীহ হাদিস অস্বীকার করতে বা জাল হাদীস গ্রহণ করতে পিছপা হয় না ৷ যেমন সহীহ হাদীসে আছে রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘‘আমার উম্মত ৭৩ ভাগে বিভক্ত হবে ৷ কেবল একটি জান্নাতে যাবে, বাকিরা জাহান্নামী হবে’’৷ Modernist-রা এই হাদীসটি অস্বীকার করে ৷ কিন্তু, “আমার উম্মতের মধ্যে মতপার্থক্য রহমতস্বরূপ’’– এই ভিত্তিহীন কথাকে হাদীস হিসেবে গ্রহণ করতে পছন্দ করে (আলবানীর মতে এটি ভিত্তিহীন) ৷
জ) আধুনিকতাবাদীদের মতে, যে কেউ ফতোয়া দিতে পারে এবং তারা সবচেয়ে সহজ ফতোয়া অনুসরণ করতে পছন্দ করে ৷ অথচ, আহলুস সুন্নাহ ওয়া আল জামা‘আহ্র মতানুযায়ী সেই ফতোয়া অনুসরণ করা উচিত যা সত্যের অধিক নিকটবর্তী ৷
ঝ) আধুনিকতাবাদীরা নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দকে কুর’আন ও সুন্নাহ্র উপর প্রাধান্য দেয় ৷ যেমন: একজন আধুনিকতাবাদী বলেছিলেন: ‘‘গানবাজনা হালাল, কারণ এর মধ্যে আমি খারাপ কিছু দেখি না’’৷ অথচ এই বিষয়ে কুর’আন ও সুন্নাহ্য় কি বর্ণনা আছে, তা তার কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷
‘‘আহলুস সুন্নাহ্ ওয়া আল জামা‘আহ্’’ এবং ‘‘Modernism’’-এর তুলনামূলক পর্যালোচনা
আহ্লুস সুন্নাহ্ ওয়া আল জামা‘আহ্র মতানুযায়ী সত্য ধর্ম ইসলামের কেবল একটি পথই সঠিক ৷ আর সব পথই ভুল ৷ আর সেই সঠিক পথটি হচেছ আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবারা (রা) যেভাবে ইসলামকে বুঝেছেন, ঠিক সেই ভাবেই আমাদের ইসলামকে বুঝতে হবে ৷ এক্ষেত্রে নিজের ‘আক্বল বা অন্যদের মতামত কোন গুরুত্ব বহন করে না ৷ আল্লাহ্র রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবারা(রা.) যেভাবে ইসলামকে বুঝেছেন, ইসলামের সেই রূপটিই সত্য ৷ ইসলামের অন্যান্য সব রূপ মিথ্যা ৷ সহীহ হাদীসে আছে রাসূল (সা.) একটি সরলরেখা এঁকে বললেন: এই পথটিই আল্লাহ্ নির্দেশিত পথ ৷ আর ঐ সরলরেখা হতে আরও কয়েকটি শাখা বের করে বললেন: এই শাখাগুলো শয়তান নির্দেশিত পথ ৷
আহলুস সুন্নাহ্ ওয়া আল জামা‘আহ্র সাথে আধুনিকতাবাদীদের বা Modernist-দের পার্থক্য নীচে তুলে ধরা হলো:
Modernist-দের দ্বারা ইসলামের ক্ষতিসাধন
১) সাধারণ মানুষেরা জ্ঞানের অভাবে এটা বুঝতে পারেনা যে, আধুনিকতাবাদী আন্দোলন একধরনের মুনকার বা বিদ’আত ৷ তাই তারা আধুনিকতাবাদীদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয় এবং তাদের পক্ষাবলম্বন করে ৷ আধুনিকতাবাদীদের অধিকাংশ লেখায় “যুক্তিসম্মতভাবে” সব কিছু ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ৷ আর “যুক্তি” দ্বারা সব সময় যখন সিদ্ধান্তে বা সমাধানে উপনীত হওয়া যায় না – তখন মানুষ ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় ৷ এই একই ঘটনা ঘটেছে খৃষ্টধর্মের ক্ষেত্রে ৷ এখন তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ধর্ম কোন প্রভাব রাখে না ৷
২) অবিশ্বাসী সমাজ ইসলামকে ধবংস করার জন্য আধুনিকতাবাদীদের ব্যবহার করছে ৷ তাদের মাধ্যমেই মুসলিম নারীদের ঘরের বাইরে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে ৷ বিগত ২০০ বছর ধরে ঔপনিবেশিক শক্তি ও প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞরা [বা Orientalist-রা], ইসলামে নারীর মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে যাচেছ ৷
উপসংহার
আমাদের সকলকে বুঝতে হবে যে, আধুনিকতাবাদী আন্দোলন এক ধরনের বিদ’আত ( innovation) ৷ তাদের কতগুলো নিজস্ব নীতি আছে যা আহ্লুস সুন্নাহ্র বিপরীতে যায় ৷ তারা ইসলামের অপরিবর্তনীয় বিধি-বিধানের (যেমন শরীয়াহ, কুর’আন) ক্ষেত্রেও ইজতিহাদ করে ৷ তারা সাহাবাদের ইজমাকেও অস্বীকার করে, যেমন: ব্যভিচারের শাস্তি বা মুরতাদের শাস্তি ইত্যাদির ব্যাপারে সাহাবাদের ইজমাকে তারা অস্বীকার করে ৷ তারা সহীহ হাদীসকেও স্বীকার করে না ৷ যেমন: নারী নেতৃত্ব সম্বন্ধে যে সহীহ্ হাদীস রয়েছে তারা তা অস্বীকার করে। আধুনিকতাবাদীদের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামে নারীর অবস্থান পরিবর্তন করা ৷ তাদের কাছে ছেলে-মেয়ের মেলামেশায় কোন বাধা নেই ৷ তাদের কাছে হিজাবও গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷ আধুনিকতাবাদীদের এইসব ধ্যান-ধারণা পশ্চিমাদের দারুণ পছন্দ হয়েছে এবং তারা আধুনিকতাবাদীদের প্রশংসা করতে শুরু করেছে ৷
[লেখাটা আমার নয়। বরং বিশ্ববিখ্যাত ধর্মান্তরিত একজন আমরেকিন স্কলারের। মূল ইংরেজী লেখাটা রয়েছে এখানে:
Click this link…