সমুদ্রে জীবন – ১২

“সমুদ্রের অনেক রূপ, অনেক রং – প্রতিনিয়তই তার রূপ ও রং বদলাতে থাকে। অনেকে মনে করেন সমুদ্রগামী মানুষের জীবন কি একঘেঁয়ে আর বিরক্তিকর হবার কথা – যে দিকে তাকাবে সেদিকেই তো সে শুধু সীমাহিন জলরাশি দেখবে। এটা ঠিক যে, কোন কোন মানুষের চোখে সমুদ্রের অগণিত ভিন্ন রূপ ধরা নাও পড়তে পারে। তবে যাকে আল্লাহ্ দৃষ্টি দিয়েছেন – সে দেখবে আপাত দৃষ্টিতে বৈচিত্রহীন সীমাহীন জলরাশি মনে হলেও, সেখানে কোন দুইটি সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় একরকম নয়, যেমন একরকম নয় কোন দুটি ভোর বা সন্ধ্যার আকাশের রং। আর জলরাশির রং? সেটার বৈচিত্র ভাষায় বোঝানো কঠিন – হালকা নীল থেকে শুরু করে সবুজ পর্যন্ত যত shade হতে পারে তার সব তো দেখা যায়ই – আবার আবহাওয়ার ও পানির গভীরতার পরিবর্তনের সাথে সাথে গাঢ় নীল থেকে প্রায় কালো রং ধারণ করে সমুদ্র-জলরাশি। বৈচিত্রের আরেকটা দিক হচ্ছে জলের surface-এর চেহারা। কখনো তা কাঁচের মত সমতল – জাহাজের গতিকে তখন খুব নিষ্ঠুর মনে হয়, সেই কাঁচের মত সমতল নিরবচ্ছিন্নতাকে ভেঙ্গে এগিয়ে যায় বলে। আবার ঐ একই সমতল কিছুক্ষণ পরেই হয়তো কয়েক মিটার উচ্চতার অগণিত ঢেউয়ে ভরে যায়।”

প্রথম যখন সমুদ্র নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম, তখন উপরের কথাগুলো লিখে এমন একটা ব্লগে খসড়া হিসেবে save করে রেখেছিলাম, যার system-টা বেশ user friendly মনে হয়েছিল। সেই user friendly মনে করাটাই আমার জন্য কাল হলো। বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে – অসুরের সুর সৃষ্টির প্রচেষ্টার মত করে – “সমুদ্রে জীবন-১২” একটু একটু করে লিখছিলাম bits and pieces-এ । লেখার পরে save করতে ভুল হতো না । কিন্তু হঠাৎ একদিন save করতে গিয়ে কোন bug-এর কারণে এক অদ্ভূত ব্যাপার ঘটলো – পুরা লেখাটা হারিয়ে গিয়ে একটা “no title” শিরোনামের খালি পাতা আসলো। সেদিনের কাজের আগের অনেকটুকু কাজও সাথে হারিয়ে গেল। ঐ ব্লগের support team-কে জানালাম। তারা রেসপন্স করতে করতে দুই/তিন দিন চলে গেল। বললো, চেষ্টা করে দেখবে উদ্ধার করা যায় কি না – কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন জানালো কিছুই করার নেই। ছাত্র-জীবনে আমি সব সময় চাইতাম, পরীক্ষাগুলো যথাসময়ে হয়ে শেষ হয়ে যাক। পূর্ণ প্রস্তুতির পরে যখন অন্যান্যদের প্রস্তুতি হয়নি বলে শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা বাতিল হতো – তখন খুব হতাশ লেগেছে সব সময়। লেখাটা হারিয়ে গেলে অনেকটা সে রকম অনুভূতিই হলো আমার। গোটা রমযান মাসে আর লেখাটা পুনরায় শুরু করার কোন এনার্জি বা সময় পেলাম না!

যাহোক, আগের মূল লেখাটার মত না হলেও, চেস্টা করবো “সমুদ্রে জীবন-১২” লেখাটাকে reconstruct করতে। “সমুদ্রে জীবন – ১১” -তে San Francisco Bay Area নিয়ে কথা হচ্ছিল। ওখানে যেতে শুরু করার ঠিক আগে আগে আমি দূর-প্রাচ্য থেকে ইউরোপের মাঝে যাতায়াতকারী একটা বড় কন্টেইনার জাহাজে ছিলাম – in fact ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় container জাহাজ। ঐ জাহাজটায় আমি বহু বছর পরে, আবার “জাহাজে করে” ইংল্যান্ডে যাই। এর আগে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের উত্তরপূর্ব অংশের একটা শহরে বেশ কিছুদিন ছিলাম। সিলেটি হবার বদৌলতে, UK-তে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকলেও, পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডে থাকা সময়টাতে কেন যেন আত্মীয়-স্বজন – এমন কি অন্য শহরে থাকা বন্ধুদেরও তেমন একটা খোঁজ-খবর নেয়া হয় নি। আমার বেশ মনে আছে, আমার বেশ কাছের একজন বন্ধু – আমারই মত – পেশাগত পড়াশোনার জন্য তখন Southampton-এ থাকতো। আমি পরীক্ষা ইত্যাদি শেষে যেদিন দেশে চলে আসবো, তার আগের দিন Southampton-এ তার কাছে গিয়ে তার বাসায় থাকলাম – সে আমাকে পরদিন তার গাড়ী করে Heathrow-তে তুলে দিয়েছিল – ব্যস ঐ পর্যন্তই। আমি কিন্তু কখনো তখন London-এ আমার কয়েক ডজন আত্মীয় স্বজনের কারো খোঁজও নিই নি – বা কারো বাসায় যাইও নি। এ নিয়ে তাদের কেউ কেউ বেশ মনক্ষুণ্ণ হয়েছেন। এরপর তাদের কেউ কেউ প্রায়ই খোঁজ নিয়েছেন আমি আর UK যাই কি না ।

আমাদের কোম্পানীর জাহাজগুলো তখন UK-র ২টা বন্দরে যেতো – Felixstowe এবং Southampton। আমার জাহাজটার loop-এ তখন Felixstowe অন্তর্ভুক্ত ছিল। Felixstowe-র ঠিক আগের port ছিল জার্মানীর Hamburg। ঐ loop-এ প্রথম voyage-এ, জাহাজ Hamburg থাকতেই, ছেলেবেলায় আমাকে খুব আদর করতেন, আমার এমন এক মামার (আপন মামা নন) সাথে কথা-বার্তা ঠিক হয়ে রইলো – আমি সুযোগ পেলে Felixstowe থেকে London-এ তার কাছে বেড়াতে যাবো। তিনি আমাকে Felixstowe থেকে London-এর ট্রেনে London (Liverpool street) যাবার পদ্ধতি বাতলে দিলেন। বললেন Liverpool street-এ গিয়ে তাকে একটা ফোন করে তবে টিউবে উঠতে। টিউব রেলে ওখান থেকে আমি King’s Cross -এ পৌঁছানোর আগেই, তিনি ঐ স্টেশনে এসে থাকবেন – বলা বাহুল্য যে, তার বাসা King’s Cross -এর খুব কাছের একটা রাস্তা Wharton Street-এ অবস্থিত। ঐ মামাই আমার UK-তে অবস্থিত সবচেয়ে ঘনিস্ট রক্তসম্পর্কীয় নন – আমার ১টা আপন খালাত ভাই এবং ২টা আপন মামাতো বোনও ওখানে থাকতো/থাকে। তথাপি ঐ মামাকেই আমার সবচেয়ে কাছের মনে হতো, আমার সবচেয়ে ঘনিস্ট রক্তসম্পর্কীয় না হলেও, তিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট আত্মীয় – আত্মার সম্পর্কের দিক থেকে সবচেয়ে কাছের।

যাহোক, এখানে উল্লেখ্য যে container জাহাজের নাবিকদের জীবনে “বন্দরে অবস্থানের সময়টা” অত্যন্ত মূল্যবান – যে তুলনায় পশ্চিমা জগতের আপাত দ্রুতগতি জীবনটাকেও অনেকসময় ঢিলে-ঢালা মনে হতো। যেমন ধরুন Felixstowe, বন্দর হিসেবে বড় হলেও শহর হিসেবে “ছোট্ট একটা মফোস্বল” শহর বলা যায়। সকাল ৬টার দিকে ওখান থেকে Ipswich পর্যন্ত একটা ২ বগির ধীর-গতি ট্রেন চলতে শুরু করে, যা রাত ১০টার পর পর বন্ধ হয়ে যায় – তাও আবার ঘন্টায় একটি মাত্র ট্রেন – যা ২৬ মিনিটে Felixstowe থেকে Ipswich যায়। একটা ট্রেন কোন কারণে মিস করলে, পাক্কা এক ঘন্টা সময় – আপনার “বন্দরে স্বল্প অবস্থানের অবকাশ” থেকে হারিয়ে গেল। তখন রাগে-দুঃখে আঙ্গুল কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। Ipswich থেকে London অবশ্য ঘন ঘন ট্রেন পাওয়া যায় – যেগুলো Norwich বা অন্যন্য শহর থেকে Ipswich হয়ে যাতায়াত করে। Ipswich থেকে London যেতে ১ঘন্টা ১০ মিনিটের মত সময় লাগে। খুব ভালো ভাবে প্ল্যান করতে পারলে ২ ঘন্টায় জাহাজ থেকে London (Liverpool street)-এ পৌঁছানো যায়। কখনো এমন হয়েছে যে, আত্মীয় স্বজনের সাথে একটু বেশী সময় কথা বলার খেসারত দিতে হয়েছে – ফেরার পথে রাতে Ipswich থেকে Felixstowe-র ট্রেন মিস করে ২৬/২৭ পাউন্ড টেক্সি ভাড়া গুনে।

প্রথম যেবার জাহাজ থেকে মামার বাসায় গেলাম, সেবার অনেক অজানা বিষয় ছিল – যেগুলোর জন্য কিছু বাড়তি সময় ক্ষেপনও হয়েছে। প্রথমবারের পর, ঐ বিষয়গুলো আর কোন factor হয়ে দাঁড়ায় নি। যেমন ধরুন টিউব ধরে King’s Cross না গিয়ে Liverpool street থেকে একটা টেক্সি ধরে সরাসরি মামার বাসায় চলে গেলে, আমার অনেকটুকু দুর্লভ সময় বেঁচে যেতো। প্রথম যেবার ওভাবে মামার কাছে গেলাম, মামা তার বড় মেয়েকে নিয়ে King’s Cross-এ এলেন আমাকে নিয়ে যেতে – আমাকে বললেন সাব-ওয়ে থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে থাকতে। কিন্তু নিজেই আর সেখানে থাকলেন না। আমার দেরী হচ্ছে ভেবে, টেনশনে, নেমে গেলেন প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য – আরো একটা কারণও ছিল তাঁর টেনশনের: প্রায় ২৭ বছর পর আমাকে দেখে তিনি চিনবেন কি না! প্ল্যাটফর্মে আমাকে না পেয়ে, আবার হন্তদন্ত হয়ে উপরে ছুটে আসলেন – কন কনে শীতে আমাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধরে নিলেন আমিই তার আত্মীয় – আমি অবশ্য একমুখ পাকা দাড়ি সমেতই তাকে চিনতে পারলাম। মামার মেয়ে আমাদের ড্রাইভ করে তাদের বাসায় নিয়ে গেলো। পথে তিনি দেশী দোকান থেকে দেশী বড় মাছ কিনলেন। বাসায় গেলে রীতিমত উৎসবমুখর পরিবেশে তিনি, তার স্ত্রী (যিনি অন্য সম্পর্কেও আমার আত্মীয়া), তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে এবং তার মেয়ে-জামাই (আমার আপন খালাত ভাই ) সবাই মিলে আমাকে ঘিরে ধরে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করলো – London-এর Wharton Street-এর ঐ বাসাটা কয়েক ঘন্টার জন্য একটা মিনি সিলেটে রূপান্তরিত হলো। আড্ডার মুখ্য subject-টা অবশ্য বেশ ব্যতিক্রমী একটা বিষয় ছিল – আমরা প্রায় সারাক্ষণই “ইসলাম” নিয়ে কথা বলছিলাম! ইউরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিঠিয়ে থাকা আমার অগণিত আত্মীয়-স্বজনের ভিতর ঐ পরিবারটিই ছিল একমাত্র পরিবার, যাদের সত্যিকার অর্থে অনুশীলনরত “মুসলিম” বলা যায়। ৫৬ দিন পরে, ইনশা’আল্লাহ্, “আবার আসিব ফিরে” – এমন একটা কথা দেয়া-নেয়ার ভিতর দিয়ে আমাদের ঐ দিনের আড্ডার অবসান হলো। এর মাঝে সিলেটি রেসিপির “হাতকরা”, শুটকি আর বড় মাছ ভাজা – এধরনের অনেক আইটেমের খাওয়া-দাওয়া হলো।

এরপর ঐ জাহাজে বা অন্যান্য জাহাজে আরো বহুবার ঐ বাসায় যাওয়া হয়েছে। কখনো ওখানে গোটা দিন বা overnight-ও থেকেছি। Felixstowe-র Trinity Dock -এর কন্টেইনার বার্থগুলোর একটা দুর্বলতা ছিল – সমুদ্রের হাওয়ার কাছে উন্মুক্ত বলে, আবহাওয়া খারাপ থাকলে একটু ঝড়ো হাওয়া বইলে gantry craneগুলো আর operate করতো না। এমনও হয়েছে যে, কোন কার্গো ওঠানামা ছাড়াই, জাহাজ হয়তো ২৪ বা ৩৬ ঘন্টা এমনি বসে থেকেছে – যেটা কোন লাইনার container জাহাজের জন্য এক বিরল ব্যতিক্রম। আমার জন্য সেটা সব সময়েই অনেকটুকু বাড়তি সময় London-এ থাকার একটা সুযোগ হয়ে এসেছে। ঐ পরিবারের সাথে জাহাজী জীবনে আবার নতুন করে পরিচিত হওয়াটা আমার জীবনের একটা turning point হয়ে যায়!

mariner77_1284569124_1-AGT

[আমার নাবিক জীবনের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজটির ছবি। নীচের ছবিটাও একই জাহাজের – তবে রং পরিবর্তন করার পর তোলা ছবি]

 

 

mariner77_1284569308_2-agt-sea

[আমার নাবিক জীবনের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজটির ছবি। জাহাজটি ৫,৪০৪টি কন্টেইনার বহনক্ষমতা সম্পন্ন। ইন্জিনের ক্ষমতা ছিল ৬৬,১২০ ব্রেক হর্স পাওয়ার। দৈর্ঘ্য:২৭৫ মিটার, প্রস্থ:৪০ মিটার। জ্বালানী তেল ধারণক্ষমতা: প্রায় ৭৩১৬ টন ।]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *